তােমাকে সােহাগ শৃঙ্গার (PRIAPEIA) -লিওনার্ড স্মিথের্স এবং রিচার্ড ফ্রান্সিস বারটন

February 17, 2021 | By Admin | Filed in: বিখ্যাত লেখকদের সাহিত্যে যৌনতা.

অনুবাদঃ পৃথ্বীরাজ সেন

অবতরণিকা

প্রীতম এক প্রতীক চরিত্র। প্রাচীন লাটিন কাব্য ইতিহাসে তাকে বলা হয়েছে অনন্ত পৌরুষের প্রতীক। সে সুদেহের অধিকার। পৌরুষ তার আকাশ ছোঁয়া। তার শরীরের সবথেকে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল সুদৃঢ় পুংদণ্ড। যার সাহায্যে সে অসংখ্য রমণীকে তৃপ্ত করেছে।
আশ্চর্য এই চরিত্রটিকে নিয়ে রােমদেশীয় কবিরা অসংখ্য কবিতা লিখেছেন। এগিয়ে এসেছেন মাসিয়াল পেট্রোনিয়াস, ব্যাটুলাস ওভিল, টাইবুলাস এবং সিনার-এর মতো বিখ্যাত কবিরা। তাঁদের রূপকল্পনাতে প্রীতম কখনাে হৃয়ে উঠেছে এক অনন্য পুরুষ, কখনােবা অবদমিত যৌনতার প্রতীক। তাঁরা কখনাে নারী হয়ে প্রীতমকে আকর্ষণ করেছেন, কখনো পুরুষ হয়ে তাকে আহবান করছেন দ্বন্ধ যুদ্ধে।
এভাবেই যুগে যুগে প্রীতম কিংবদন্তীর এক চরিত্রে পরিণত হয়েছে। আজও আমাদের চোখে সে শেষ না হওয়া প্রশ্নের দ্যোতক। তাকে ঘিরে আজ অনেক জিজ্ঞাসার উত্মরােল। প্রীতমকে নিয়ে লেখা অসংখ্য কবিতার ইংরাজি অনুবাদ করেছিলেন স্যার রিচার্ড বারটন। তারই সংক্ষেপ তুলে দেওয়া হল এখানে।
বছরের পর বছর কেটে গেছে। পৃথিবী অনেকখানি পাল্টে গেছে। তবুও স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, প্রীতম আজও আমাদের যৌবন দিনের এক ধ্রুবতারা হয়ে জেগে আছে। আগামীকাল সে এমনভাবেই থাকবে আমার মনের আকাশে উজ্জল এক তারকা হয়ে।

তােমাকে সােহাগ শৃঙ্গার

রাতের আঁধারে ও দাঁড়িয়েছিল। ওর নগ্নিকা দেগ থেকে ঝড়ে পড়ছে ব্যথাতুর জ্যোৎস্না। আমি অপলক ওর দিকে তাকিয়ে আছি। আমার কেবলই মনে হচ্ছে, এখনই আকাশের বুকে একটুকরাে মেঘের আবির্ভাব হবে। চাদমুখ ঢাকবে লজ্জায়। নীল একটা জ্যোৎস্না চারপাশে জেগে আছে একা। একটু বাদে সবকিছু ঘন কালাে অন্ধকারে মিশে যাবে।
আমি তৃষিত তাপিত হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছি। এ জীবনের সকল উচাটন মনে পড়ে যাচ্ছে আমার। আমি ভাবছি, কখন ওর কিশােরী কুচযুগে রাখব আমার ভালােবাসার পরশ। প্রথম প্রণয়ের স্পর্শে ও হবে কম্পিতা, বিহ্বলা। বাতাসের আলুথালু ছোয়ায় ঈষৎ, কাপবে ও দোলায়িত হবে ওর সমস্ত তনুবাহাযর। আশ্বিনের ঈশ্বরী ‘আকাশে সূর্য হেসে উঠবে হাহা করে। ওর বৃন্তের গঠন হবে আরাে দৃঢ়। অঝোর বৃষ্টি নামবে তিয়াসের কোলে। জীবন ক্ষুদ্র হয়ে আসবে। তারপর, বিশ্বাসের নিটোল উপত্যকায় পা রাখব আমি একা।

কোনাে এক সুদরতমার প্রতি

তােমাকে দেখেছিলাম আধো ছায়া, আধো অন্ধকারে। তুমি ছিলে নৈঃশব্দের মধ্যে একা। শূন্যতার এক অর্থময় সঙ্কেত তােমার চোখে জ্বেলে দিয়েছিল নিশান্তিকার আলাে। বিষণ্ণতার মধ্যে একটা অন্তত অব্যক্ত আনন্দ ছিল। রৌদ্রময় মরীচিকা ঢেউ তুলেছিল মরুভূমিতে। আর আমি, তােমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়েছিলাম।
হে আমার ইচ্ছের কাছে নতজানু স্বপ্ন, হে আমার ফুল তােলা নরম সকাল, খােলা চুল, মায়াবী কপােল, দুপুরের শীত-ভেজা রোদ, বাতাসের বুকে উড়ে যাওয়া কুমারী পালক, অচেনা আদর এসে ছুয়ে গেল শরীরের সব লোমকুপ। চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল না বলা কথার উৎসব। পারিজাত প্রাণ নিয়ে তুমি বলে উঠেছিলে—“আজ নয়, অন্য আর একদিন!

তােমাকে ভালােবেসে

তােমাকে ভালােবেসে চারপাশে শুধু হুহু শ্বাস। আমার পৃথিবী জুড়ে শুধু তুমি জ্যোৎস্নার বান। পাহাড়ের স্বচ্ছতোয়া ঝরনা, আদিবাসী মেয়ে রোদে মেলে দেয় বুকের অবােধ যাচ্ঞা। আকাশের দূর নীলিমায় তােমার আলাের বৃষ্টি আমাকে ভেজায়, আমাকে পােড়ায়, তােমাকে ভালােবেসে আমি আলাের সৌরভে মেতে উঠি।

কথা রাখা, কথা দেওয়া

ছলচাতুরির চতুৱালি-পথে পাইনি তােমার দেখা, তােমার বিরহে শয্যা পেতেছি এখন আমি একা, অভিমানী প্রিয়া চুমুর দাবিতে লেখা এ অঙ্গীকার। প্রেমের দোহাই কোরাে না তুমি এমন অহঙ্কার!
তুমি মানুষ! পাঁজরের আগলে ঢেকে রাখি বুকের আগুন, মহুয়া মাতাল হয়ে ইচ্ছে করে রাত ভেঙে বাড়ি ফিরি, হাতে ধরি মুঠো ভরা ফাগুন।
আমিও মানুষ! একলা রাতে বড়ো একা লাগে… আমার পৃথিবীতে এত মানুষের ভিড় তবু কেন তৃষিত রাত শুধু নিরালায় থাকে জেগে?

নৈঃশব্দ্যের বর্ণমালা

মনে মনে আমি সারাদিন শব্দের পর শব্দ দিয়ে সুন্দর একটা নকশিকাথা বুনি। তুমি এলে কথারা হারিয়ে যায়। দু’চোখে তােমার আকুল প্রতীক্ষা—শান্তিহীন, ক্লান্তিহীন, বিরাম বিহীন। তুমি এলে আমি কিছু বলতে পারি না। বহলাধূর্ণিতে দুলতে থাকে আমাদের সাঁকো। আলােআঁধারির পর্যটন শেষে পৃথিবীতে ফিরে আসে পরিযায়ী তারা। রক্তের মধ্যে জলতরঙ্গ বাজায় নৈঃশব্দ্যের বর্ণমালা, তবুও তোমার সামনে আমি শব্দের অহঙ্কারে আরাে একটু বেশি স্পর্ধিত হতে পারি না!

বৃষ্টি দিনের কবিতা

বৃষ্টি তােমার চোখের তারায় দু এক কিশােরী স্বচ্ছ ভালােবাসা খেলা করে। বৃষ্টি, মেঘের সঙ্গে তুমি কারেছ আপোস, ভুবনবাকে নয়ানজুলির ধারে তােমার একলা থাকার ঘর। আমি সাঁতারের সমূদ্রে স্বপ্নে ভাসাচ্ছি আমার ইচ্ছে ভেলা। মনে আছে তোমার, সেই কবে সর্বনাশে সেজেছিল কাজল ? আগুন সাক্ষী করে তােমায় আমি গ্রহণ করেছিলাম, আজ সেকথা ভুলে গেছো তুমি?
হলুদ ঘাসের উল্টো বাকে এখনও লেখা আছে আমাদের স্বয়ম্বরের ইতিহাস। সবুজ ঘাসের গােপন ডেরায় নীল চন্দন যেন বলতে চাইছে। বৃষ্টি, তুমি আঁচল মেলে ধরাে, আমি সেখানে আমার মুখ রাখব।

কত বছর আগে এভাবেই লেখা হয়েছিল এলােমেলাে কিছু প্রেম কবিতা। প্রীতমের উদ্দেশে তার অসংখ্য প্রেমিকার নিবেদন; আবার অচেনা নারীদের প্রতি প্রীতমের, ভালােবাসার দিকচিহ্ন। কালের যাত্রাপথে অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে, কিন্তু কিছু থেকে গেছে। অনাগত দিনেও থাকবে তারা। তাদের নিয়েই রচিত হল এলােমেলাে এই সম্ভাষণ। প্রেম এখানে আন্তরিক অঙ্গীকারে উৎসারিত হয়েছে, সেজেছে সে রামধনুর সাতরঙে, বসন্ত দিনের ডাক শুনে সে হয়েছে উন্নন।
শরীর বেজে উঠেছে জলতরঙ্গের মতাে। কখনাে করুণ রাগিনী বেহালাতে; কখনাে-বা বৃন্দবাদনের উচ্ছাস। আছে তীব্রতম রিরংসা। কাছে আসার দুর্মর বাসনা। চুম্বনের অভিলাষ; মৈথুনের ইচ্ছা; আছে শরীর-সঙ্গমের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ—যা আমাদের অবাক করে দেয়। সব নিয়েই এ এক অসাধারণ পত্রকাব্য!

 

প্রিয়তম প্রীতমকে

এক
তুমি যেন কালপুরুষ, মগ্ন মৈনাক, নীল নির্জনে একক পাহাড়! তুমি যেন এক অবিবেচক মানুষ। তােমার পৌরুষ অহঙ্কারে পরিপূর্ণ। তুমি তাে জানাে না কীভাবে আমি তাকিয়ে আছি তােমার দিকে!
তােমার উন্নত শির, তােমার প্রশস্ত কাঁধ, তােমার উদ্ধত অহংকার, সব কিছুকে আমি ভীষণভাবে নিজের করে পেতে চাই।
তবু কেন এই বাঁধন? তবু কেন এই উচাটন? তবু কেন লাজনত আত্মার কান্না!

দুই
ঘন অন্ধকার রাত এগিয়ে আসছে। বলো তাে প্রিয়, এখন কি একা থাকা যায়? এখন তাে তােমাকে নিবিড়ভাবে আলিঙ্গন করতে হয়। তােমার লােমরাজিতে সমৃদ্ধ বুকের মাঝে স্থাপন করতে হয় আমার হৃদয়খানি। তােমার সাথে মিলেমিশে হতে হয় একাকার।
এখন তাে তােমার কানে কানে শােনাতে হয় ভালােবাসার গল্পকথা। বলতে হয়‘আহা, তুমি সবকিছু আমাকে দাও। তােমার অহঙ্কার, তােমার পেলব নিতম্ব, আমি রানি মৌমাছি হয়ে হুল ফোটাবাে। আমি ভালােবাসবাে, তুমি আমার, একান্তভাবে আমারই!’

তিন
ভালােবাসার আর একটা অর্থ আছে, আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা সেই আসল অর্থটা খুঁজে পাই না। ভালােবাসা মানে কাছে আসার নিগূঢ় প্রবৃত্তি; একে অন্যকে অধিকার করার দুর্মর ইচ্ছা। ভালােবাসা মানে শরীরে শরীরে মিলেমিশে একাকার। আনন্দঘন মৈথুনের প্রস্তুতি। এছাড়া ভালােবাসার আর কোনাে অর্থ কি থাকতে পারে?
—আমি তাে বুঝতে পারি না!

চার
প্রীতমকে- না, শর্তসাপেক্ষে কাউকে ভালােবাসা যায় না। ভালােবাসা হবে আকাশের মতাে নীলিম, বাতাসের মতাে নিভার। তার পায়ে কেউ এসে কর্তব্যের শেকল পরাবে না।
কেউ চোখ রাঙিয়ে বলবে না—তুমি শুধু এতক্ষণ আমার সঙ্গে থাকতে পারবে, বাকি সময় তােমাকে কাজের কারাগারে বন্দি হয়ে থাকতে হবে।
ভালােবাসাকে এভাবে শেকল পরালে সে অকারণে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।

পাচঁ
প্রীতমকে আরাে একটি কবিতা—তুমি কি জানাে আমি শুধু তোমার জন্য নিবেদিতপ্রাণা? আহা, তােমার পৌরুষের ওই কৃত্রিম অহঙ্কায় আমাকে অদ্ভুত আকর্ষণে ডাক দিচ্ছে। আমি কি সেটিকে আমার মধ্যে প্রবেশ করাব। তাতে আমি কতখানি আনন্দ পাব? কখানি সুখ এবং শিহরণ ? আমার লাগবে! কোমল তনুবাহার রক্তাক্ত হবে! তুমি কি সত্যি। সত্যি একটি স্পন্দিত অহঙ্কার নিয়ে আমার সামনে আসতে পারাে না? আমাকে দিতে পারাে , কাঙ্খিত সেই সুখ, যা একজন নারী সবর্দা প্রার্থনা করে থাকে!

ছয়
প্রীতম, আমার আগের চিঠি পড়ে তুমি রাগ করেছে? নাকি ভেবেছাে, আমার সঙ্গে আর সম্পর্ক বজায় রাখবে না তুমি। বিশ্বাস করাে, তােমাকে যখন আমি চিঠি লিখি, সব কেমন যেন গােলমাল হয়ে যায়। কোনাে কথাই আমি আর গােপন রাখতে পারি না। প্রীতম, আমার চিঠি পড়ে তুমি কি আমাকে এক বেহায়া মেয়ে বলে ভাবছ যার লাজলজ্জার বালাই নেই? কিন্তু তােমার কাছে আমি কেন লাজবর্তী হয়ে থাকব বলাে তো? তুমি তাে সেই মনের মানুষ, যে এসে একে একে হৃদয়ের সক’টি জানালা দেবে খুলে! যে হৰে দস্যু, অনায়াসে লুঠন করবে আমার তিল তিল করে জমিয়ে রাখা শরীর-সম্পদ! আমাকে গর্ভবতী হবার সৌভাগ্য দেবে! তােমাকে কি আমি দরজা বন্ধ করে দূরে সরিয়ে রাখতে পারি?

সাত
আরো একবার, আরাে একবার তােমার কথা মনে পড়ে গেল আমার! মনটা নানা কারণে চঞ্চল হয়ে আছে। কতদিন তােমার সঙ্গে দেখা হয়নি বলে তাে প্রীতম? আমি শুনেছি, তুমি নাকি সুন্দরী মেয়ে দেখলেই ছুটে যাও আসলে আমার বিরহ তোমাকে আরাে একটু বেশি দুঃখকাতর করে তুলেছে আর সেটা আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি। তুমি তাে ওইসব উদ্ধত যুবকদলের মতাে নও যারা বারে বারে প্রেমিকা পাল্টে ফেলে। তুমি অনেক খোঁজাখুজির পর যাকে পেয়েছ, তাকে নিয়েই সুখি সম্পৃক্ত হতে চাইছ। কিন্তু তা হচ্ছে কোথায়? একটা অনভিপ্রেত সমস্যা এসে আমাদের মাঝখানে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। ঠোট থেকে হাসি হারিয়ে গেছে। মুখ এখন অকারণে গম্ভীর করে রাখতে হয়। আমি যেই ভাবছি, হায় প্রীতম, যদি এভাবে তােমার আর আমার মধ্যে দুস্তর ব্যবধান তৈরি হয়, তাহলে আমরা যুগলবন্দি দিন কাটাব কেমন করে?
প্রীতম, লক্ষ্মীটি, এভাবে রাগ করে দূরে চলে যেও না! তুমি তাে জানাে না, কোন্ স্বর্গভূমিতে তুমি এখন পা রেখেছাে। তুমি একটুখানি অপেক্ষা করাে, আমি নগ্নিকা কন্যা হয়ে আসছি। আমি তােমার কোলের ওপর উপবেশন করব। আমি মাঝে মধ্যে তােমার অহঙ্কারের পৌরুষে আঘাত করব। সেটিকে মুঠোবন্দি করার চেষ্টা করব। তারপর, যখন চরম সময়টি আসলে, আমি তােমাকে আরাম দেব। এমন আরাম তুমি আর কোনাে মেয়ের কাছে কখনাে পাবে না।

আট
তুমি কেন এভাবে আমাকে অনাবৃতা করেছো? তোমার কি মনে পড়ে যাচ্ছে বিশ্ববিধাতা জুপিটারের কথা? তার হাতে বজ্রের চাবুক আছে। তিনি সমুদ্রের দেবী নেপচুনের উদ্দেশে নিবেদন করেছেন তার অশেষ ভালােবাসা। তিনি এভাবেই আমাদের যৌন চেতনাকে আরাে উদ্দীপ্ত করেছেন। ফোবসের কথাও কিছু কিছু মনে পড়ছে না তােমার? যার হাতে ছিল সোনালি তীর। ডায়নাকে যিনি ভালােবাসতেন গােপনে! অ্যালফি দেশের কথাও তাে আমার মনে পড়ে যাচ্ছে। মনে পড়ছে সেই ডানাওয়ালা দেবল মার্কারির কথা। ব্যাকাস কীভাবে নিজেকে প্রকাশিত করেছিল হে প্রিয়তম, সে গল্পটাও তাে তোমার জানা আছে। তুমি সেভাবে আমাকে আদর কর। আমার গোপনাঙ্গে হাত রাখাে। আমি তাে তা তােমার জন্যই উম্মক্ত করে রেখেছি। আমার হাতে কোনাে অস্ত্র নেই, আমি অভয় দিচ্ছি, তোমাকে কোনােভাবেই আমি বক্তাক্ত করব না।

নয়
প্রীতম, আমাকে দেখে হাসছে কেন? তােমার কাছে আমি কি অকিঞ্চিৎলা এক নারী। তুমি কি আমার অবয়বের মধ্যে প্রচীন গ্রিক ভাস্কর্যের সৌন্দর্য খুঁজে পাও না? তোমার কি মনে হয় না অমির মূর্ব-আঙ্গে কোনাে এক সুনিপুণ শিল্পীর কারুকাজ আঁকা আছে? এই যে আমার শরীর, আমায় মুখমণ্ডল, আমার স্ত্র-অঙ্গ—সবকিছুতে মিলেমিশে আছে যেখনের উম্মলিন।
প্রীতম এসো, আমাকে লেহন করাে। আমি যে আর থাকতে পারছি না। প্রতি মুহূর্তে তােমায় কথাই মনে পড়ছে। একটা অদ্ভুত গােহানির শব্দ ভেসে আসছে আমার বুকের ভেতর থেকে। তুমি এসে আমার সকল যন্ত্রণার অবসান ঘটাও।

দশ
প্রীতম, সাবধানে আমার হাতে হাত রাখো। না, আমি কথা দিচ্ছি, তোমাকে নিয়ে কখনাে নরকের অভ্যন্তরে প্রবেশ করব না। তােমার ওই দীর্ঘ অহঙ্কারটি অতি সন্তর্পণে আমার গহ্বরে ঢুকিয়ে দাও। এই তাে আমি দুটি পা দুদিকে প্রসারিত করে বসে আছি। এই দেখো আমার বিবর। হ্যা, তােমার জন্য আমি সেখানে চন্দনরেণু লাগিয়ে রেখেছি। তুমি এসাে, তুমি আমার সর্ব অঙ্গে বাসনার প্রদীপ জ্বেলে আসল কাজে প্রবৃত্ত হও।
বহুমানা স্রোতস্বিনীর মতো সময় বয়ে চলেছে, অচিরেই যৌবন সূর্য অস্তমিত হবে। তার আগে এসাে প্রিয় প্রীতম, আমরা মৈথুনের আনন্দে মেতে উঠি।

এগার
এবার তার কথা বলি একুবার কথা। ও হল সকল রমণীর জননী এবং হেক্টার। মনে হয়, ও না থাকলে পৃথিবীতে আনন্দ থাকত না। থেসাসের গল্পকথাও মনে পড়ে যাচ্ছে। কবরের অন্ধকারে থেসাস দাঁড়িয়ে আছে। তারা সবাই মিলে এমন একটা মায়াবী জগৎ তৈরি করেছে, যেখানে না জানি কত জন্মের আলাে আছে, প্রার্থনা আছে, আছে সুশ্রী মুখমণ্ডলের উপস্থিতি। তাদের থেকে আমরা এখন অনেক দূরে চলে এসেছি এটা সত্যি। আমাদের পােশাক ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। আমরা সূর্যাস্তের রঙে উদ্ভাস পৃথিবীর জন্ম কাহিনী শুনছি। তবুও আমাদের মনে জেগে আছে প্রাক-ইতিহাসের প্রতি সেই আকাক্ষা, যা আমাদের আরাে বেশি আনন্দ দেবে। আরাে বেশি শীতল শিহরণ জাগাবে। এসাে প্রীতম, ‘আমরা সােহাগ সম্পৃক্ত মুহূর্তে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে যাই।

বারো
প্রীতম, আমি তােমাকে সাবধান করে দিচ্ছি, তুমি এভাবে আমাকে প্রতারিত করার চেষ্টা করাে না। তােমার মর্ষকাম আমাকে বাধা দেয়। ধর্ষক হয়ে তুমি যখন আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ো, আমার সর্ব-বেহালার করুণ রাগিনীতে কে যেন বাজিয়ে দেয় হংসধ্বনির সুর। আমি তাে তােমার জন্য তৃষিতা, তাহলে এত ত্বারা কীসের? তুমি কি এভাবেই চিরদিন আমাকে শান্তি দিয়ে যাবে?
এসাে, আমাকে নানাভাবে উদ্দীপ্ত করো। না, এখন আর পুরােনাে পান্থায় নয়। মুখমৈথুন আমার বড়াে ভালাে লাগে। তুমি এসাে, তােমার দন্ডটিকে আমার মুখমণ্ডলে প্রবিষ্ট করাও | আমি কথা দিচ্ছি প্রীতম, এমন সন্তুষ্টি তুমি এ-জীবনে আর কখনাে পাবে না।

তেরাে
প্রীতম, এখানে-সেখানে, অন্য কোনােখানে—এভাবেই শুরু হােক আমাদের অন্বেষণা। প্রাচীনকালের মতাে আমরা হারিয়ে যাই স্মৃতির উপত্যকায়। জেগে উঠি কোরাসের প্রস্তুরে। জুজিনালের লেখা অসামান্য কবিতাগুলি পড়তে পড়তে আমরা একে অন্যকে আর করি! কত কথাটি আমাদের মনে পড়ে যাবে। হারানাে শৈশব ফিরে আসিবে ক্ষণকালের জন্য। দুষ্টুমিভরা কিশাের-কাল, প্রথম উত্তেজনার আবেগে থরােথরে কাপতে থাকা যৌবন, প্রাঙ্গ মধ্যবয়স—সবাই তো মিছিল করে হেঁটে চলেছে মনের উন্মুক্ত সরুণী দিয়ে। এসাে, এসাে প্রিয়তম, আজ একটু অন্যরকম যে আদর দেওয়া যাক। আজ আমরা আনন্ত্রের মধ্যে দিয়ে হারিয়ে যাই হারানাে দিনগুলিতে। যখন আরাে বেশি নীল ছিল আকাশ এবং বাতাস ছিল আলাে বেশি পবিত্র। সূর্য থেকে ঠির আসত অজস্র আলাের উৎসার। এসাে প্রিয়তম, তুমি আমার এই খেলায় সঙ্গী হবে তো?

চোদ্দ
না, এভাবে নয়, এই অসৎ পদ্ধতি আমার ভালাে লাগে না। তােমার বিরুদ্ধে আমি অনেক অভিযােগ জানাতে পারি। তুমি কি আমাকে এক বৃহন্নলা ভেবেছাে নাকি? এসাে, তােমাকে মার্শিয়াল আর জুভেনালের গল্প বলি। সেই রােমদেশীয় সুন্দরীরা কীভাবে ভালােবাসা নিবেদন করত বলাে তাে? তারা চৌষট্টি কলাতে ছিল পারদর্শিনী। তাদের গুন ছিল ইস্পাতের তরবারির মতো তীক্ষ্ণ। তাদের পশ্চাৎদেশে গভীর গােপন উপত্যকার হাতছানি। এভাবেই তারা এক পুরুষ থেকে অন্য পুরুষের কাছে চলে গেছে। তারা হেমলকের বিষ পান করেছে। তারা হেসে উঠেছে অনুত আমন্ত্রণ হাসিতে। তাদের কোমল পেশিতে হাজার রজনীর ছন্দ কেঁপেছে। তারা বলেছে—এসাে এসাে, এভাবে নয়, অন্যভাবে, তুমি যেমনভাবে চাইবে আমি তােমাকে ঠিক সেইভাবেই আরাম দেব। দোহাই, তুমি আমাকে ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেও না।
আমিও ঠিক সেইভাবেই তোমার সাথে সংযুক্ত হতে চাইছি। তােমায় বৃহৎ দুটি গােপন অঙ্গ আমাকে ডাক দিচ্ছে। তােমার ওই জেগে থাকা দণ্ডটি আমাকে প্রতি মুহুর্তে উৎফুল্ল করছে। কিন্তু আমি জানি, মৈথুনের পূর্ববর্তী মুহূর্তকে আরাে সম্পৃক্ত করতে হয়। কথার মধ্যে আনতে হয় অদ্ভুত মাদকতা। সােহাগকে করে তুলতে হয় স্পর্শবন্দী। নাহলে মিলন ক্লান্তিকর। এক ধারাবাহিকতায় পরিণত হয়। হারিয়ে যায় তার সকল উত্তেজনা!

পনেরাে
প্রিয়তম প্রীতম, বুনাে গোলাপের নির্যাস আছে আমার শরীরে। সষত্নে আমি জমিয়ে রেখেছি আমার হেদ বিন্দুগুলিকে, তােমার হাতে কোনাে এক বাসন্তী সকালে নির্দিধায় সব তুলে দেব বলে।
আমি তােমার জন্য আটালান্টা পার হয়ে যাব। তুমি হবে আমার হিল্লোমেনাস। হাতে তিনটি আপেল রেখে আমি তােমাকে নানাভাবে উত্তেজিত করব। তার একটিতে কাম, অন্যটিতে বাসনা এবং তৃতীয়টিতে নির্লিপ্তি। এই তিনটির সংযুক্তিতেই তাে যৌবন আরাে বেশি মায়াময় হয়ে ওঠে।
কখনাে শেষ বিকেলে আমি সেজে উঠব নাসিকার সজ্জাতে। আলসিসের সেই কামনাকৃত মেয়েটি, ফোসিয়ার রাজকুমারীর বাসনা ইতিহাস হয়ে আছে। রাজপুরুষ থেকে শুরু করে পরিচারক কাউকেই ছাড়তো না । প্রতিদিন একটি নতুন কিশােরকে আনা হত ওঁর সামনে। সেই ছেলেটিকে তারিয়ে তারিয়ে লেহন করত ও। আহা, নাসিকার উন্মাদ যৌনতা আমি কি আমার মধ্যে পাব না?
এসাে এসাে প্রিয়, তােমাকে আমি চিঠি লিখব, অ্যাকোনটিসাসের মতাে। সেই চিঠির ভেতর উন্মুখ ভালােবাসার গল্পকথা থাকবে। শ্রাবণ সন্ধ্যার বিষন্নতা ঝরে পড়া থাকবে। থাকবে এমন আরাে কিছু যা যাতে বর্ণনা করা যাবে না।
এসাে, তুমি কিন্তু আমার সামনে পাথরের টেবিলের ওপর সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে বসবে। আমি মাঝে মধ্যে তােমার পুংদণ্ড এবং মাঝে মধ্যে তােমার উরুদেশের দিকে তাকিয়ে থাকা এবং আরাে বেশি উন্দীপ্ত হয়ে উঠব। না হলে হে, উলঙ্গ মহারাজ, কীভাবে আমি আমার মনের বাসনাদীপ্ত আবেগগুলির মুক্তি ঘটাব!

ষোলো
কে বলেছে, তােমাকে এভাবে দুরে চলে যেতে? কি বলেছে তােমাকে রাত প্রহরী হয়ে জেগে থাকতে আমার চারপাশে? তুমি কি আরাে বেশি উন্মুক্ত হতে পারে না? তুমি কি আমাকে দিতে পারাে না সেই সুধা, যার জন্য আমি আপিল হয়ে অপেক্ষায় আছি।

সতেরো
তোমাকে একটা পুরােনো কবিতা শােনাই। যার মধ্যে লেখা আছে মানব-মানবীর চিরন্তন প্রেম কাহিনী। যার মধ্যে লিভিয়ার আত্মত্যাগের কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, সেই কামনার্দীপ্ত ঘােটকগুলির কথা, যারা ঘােটকিদের জন্য পাগল হয়ে উঠেছিল। যার মধ্যে স্কুল পালানাে একটি কিশােরের ভ্রান্সিতে জমে ওঠা নিষিদ্ধ ‘উল্লাস জেগে আছে। জেগে আছে ক্যাপাসিয়াসের হাসি, আছে ড্রপারি ফলের বিষাক্ত আর্তনাদ! ‘আহ, একই শষ্যায় পাশাপাশি শুয়ে থাকা দুই নরনারী—তাদের মধ্যে দুস্তর ব্যবধান। আকাশ থেকে ঝুলতে থাকা নির্লিপ্তির অহঙ্কার। এসাে, এসাে প্রীতম, আমি তোমাকে পুরােনাে পৃথিবীর সেই গল্পকথা শােনাই। শােনাই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে জমে ওঠা অসীম উদাসীনতার কথা। কেউ কাউকে চিনতে পারছে না। একই ঘরের বাসিন্দা হওয়া সত্ত্বেও তাদের মধ্যে দূর, ব্যবধান। এসাে, এসাে প্রিয়তম, আর আমি থাকতে পারছি না। আমার তাে মনে হচ্ছে, আমি ছাড়া এই পৃথিবীর অন্য মেয়েরা সকল দিক থেকে দুঃখী। তারা তােমার মতো একটি সকল পুরুষের সন্ধান পায়নি, যার সুউন্নত ‘অহঙ্কারের দন্ডটি জীবনের সমস্ত দুঃখ কষ্টের অবসান ঘটাতে পারে!

আঠারাে
প্রীতম, থেলেসুস্কার কথা মনে পড়ছে। সেই মেয়েটি–বিষম্ভবতী এবং রহস্যময়ী। যখন তখন যে হাতের মধ্যে ধারণ করত বাঘনখ। সঙ্গমের এক মুহর্তে প্রিয়তমের দেহে বসিয়ে দিত তা। ফিনকি নিয়ে রক্ত ছুটে আসত। নানা প্রীতম, আমি কিন্তু নিরস্ত্র। আমি কিন্তু ফারেয়ার মতো তােমার জন্য বসে আছি। আমি অনেক কষ্টে এমন একটি কঠিন আসন শিখেছি, যা তােমাকে অসীম সন্তুষ্টি দেবে। তুমি একাধারে আমার দুটি বিবরকে খুশি করবে। তুমি নির্ভয়ে আমার ওপর স্থাপন করতে পারাে তােমার শরীরটিকে। এটিকে গ্রহণ করার জন্য আমি সেই কিশােরীবেলা থেকে অপেক্ষায় আছি।

উনিশ
আকাশে বজ্রপাত। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। মনে করাে নির্জন বনপথে আমি পথ হারিয়েছি। আমার চারপাশে ঝিকিয়ে উঠছে জোরে হাসি। আমি দেখতে পাচ্ছি নেপচুনের ত্রিশূলটিকে। আমি দেখতে পাচ্ছি লাল যুদ্ধবাজ্জ মার্শের ঘােড়াগুলিকে। মিনার্ভা তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমার এই অবস্থা দেখে তারা সকলে হাসছে। ব্যাক্কাস ফিরছে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে। দুয়ের ইশারা লেখা আছে তার প্রশস্ত্র মুখমণ্ডলে । অনেক দূর আকাশে আপেলের মুখচ্ছবি! হারকিউলিসের মতাে এক মহাবীরকেও আমি হাঁটতে দেখলাম।
এই অবস্থায় কে আমাকে রক্ষা করবে ? কে এসে আমার হাতে হাত রাখবে এবং চোখ থেকে নেয়া ভালােসায় সমস্ত নির্যাস সঙ্কুশে চুরি করতে করতে বলবে তুমি সুন্দরী, তাই তােমাকে ভালােবাসি। তুমি রূপসী, তাই বারে বারে তােমার কাছে আসি। আমাকে তুমি বিশ্বাস করাে। তুমি আমার একমাত্র প্রিয়তমা!’

কুড়ি
আমার অঙ্গে ছিল হিরের বাঁধন। পৃথিবীর সবথেকে দুষ্প্রাপ্য মুক্তো দিয়ে আমি সাজিয়েছিলাম আমার সাতনরি হার। আমার কোমরে শােভা পাচ্ছিল ভারতের সােনার অলঙ্কার। আমার পায়ে ছিল এমন এক পায়েল, যা এসেছে সুদুর আমেরিকা থেকে। এভাবেই আমি পৃথিবীর সবথেকে ঐশ্বর্যবতী হয়ে উঠেছিলাম। হায় প্রীতম, আমার মন হয়তাে অকারণে অহঙ্কারী হয়ে উঠেছিল। একে একে আমি আমার সমস্ত রত্নরাজিকে হারিয়েছি। আজ আমি নিঃস্ব, ভিখারিনি। হৃদয় ছাড়া দেবার মতো আর কিছুই নেই আমার। আছে অঙ্গ বাহার। ‘তা কি হিরের থেকেও দুমূল্য নয় ? আমার এই কোমল শংখসদৃশ পেলব দুটি স্তন, আহা, পৃথিবীর কোনাে রত্ন কি লড়াইতে তার সাথে জিততে পারে? আর এই নির্লোম ত্রিবলি ত্রিভূজ! এসাে, তাকে তুমি বসুন্ধরার মহার্ঘতম অস্ত্র হিসেবে চিন্তা করো।
এই তাে আমি তােমার প্রেমিকা, এক নগ্নিকা সুর-সুন্দরী, আভরণহীনা হয়েও ঐশ্বর্যবর্তী, তুমি কি আমাকে গ্রহণ করবে না।

একুশ
নারী পুরুষের কাছে কী চায়? কেউ বলে শরীর, যা তাকে সন্তুষ্টি দেবে।
কেউ বলে প্রেম, যা তার জীবনে জেগে থাকবে তারার মতাে।
কেন্দ্র তলে নিরাপ, যা তার চারপাশে রচনা করবে একটি বলয়।
কেউ বলে কিছুই না, শুধু মুঠো মুঠো খুনসুটি, যা দিয়ে প্রতিটি দিন হবে বসস্তু দিন;
প্রতিটি রাত-আকাশে জ্বলে উঠেয়ে দেওয়ালির আতসবাজি।

বাইশ
পড়ে আছে একগােছা রঙিন ফুল। আহা, ওদের এমনটিই থাকতে দাও।
দেখা যাচ্ছে গোলাপ সুন্দরীদের। আহা, বাসন্তী সন্ধ্যায় ওদের ওপর যেন তোমার কুনজর বতি না হয়।
যৌবনবতী আপেলগুলি ঝুলছে গাছ থেকে, তালের সুগন্ধে বাতাস ভরপুর হয়ে উঠেছে।
এখনই তো ভালােবাসতে হয়। এখনই তো কাছে আসতে হয়। এখনই তাে অল-অবরণ সরিয়ে রাখতে হয়। এখনই তাে একে অন্যকে আলিঙ্গন করতে হয়। এখনই তো বলতে হয়, তুমি সুন্দর, তাই তােমাকে এত বেশি ভালোবাসি আমি!

তেইশ
কি অভিযােগ আমার বিরুদ্ধে? আমি কি তা জানতে পারব না। তুমি আমাকে বলছে, আমি এক তস্কর, এক নিশিকুটুম, আমি চুপিসাড়ে তােমার মন চুরি করেছি।
হ্যা, হ্যা প্রীতম, আমি আমার বিরুদ্ধে আনা এই সমস্ত অভিযােগ নতমস্তকে স্বীকার করে নিচ্ছি। তুমি যদি এর জন্য আমাকে শূলে চড়াও, আমি হাসব। তুমি যদি ফাঁসিকাঠে আমার কোমল তন্বী তনুবাহার ঝুলিয়ে দাও, তাহলেও আমি হাসব।
শুধু তুমি যদি আমার প্রতি বিরূপ হও, বর্ষণ করাে নির্লিপ্তি অথবা ‘উদাসীনতা, তাহলে আমার চোখ থেকেবিতা ঝরবে—সমুদ্র-সহেলীর অশেষ কান্নার মতাে!

চব্বিশ
ভালাে লাগে না কর্মক্লান্ত দিন। ভালো লাগে না কর্তব্যের বোঝা। ভালাে লাগে না মারা পৃথিবীর ভার বহন করা। এই পৃথিবীতে এখনও অনেক সুন্নাত মুহূর্ত আছে। চুম্বন- ‘আগ্রহ থরথর কম্পমান হয়। এসো, আমরা জীবনের এইসব জটিলতাকে ভুলে যাই। আমরা প্রচীন পৃথিবীর নির্মল মুহূর্তে ফিরে যাই, যখন আকাশ সত্যি সত্যি সেজে উঠত লাজবর্তী রমণীর মতাে; গােধুলির কনে-দেখা আলােতে মনে হত, সে বুঝি সদ্য ঋতুস্রাতা এক কুমারী কন্যা।

পচিঁশ
এখানে সব কিছু আছে। আছে আমার রূপ এবং যৌবন। আছে লাস্যময়ী সুন্দরীদের আনাগােনা। আছে শরীরকে উদ্দীপ্ত করার সহস্র অস্ত্র।
এখানে আমি সযত্নে সাজিয়ে রেখেছি আমার মন। এখানে আমি প্রােষিতভর্তকা হয়ে বসে আছি। আমার চুল উড়ছে বেলা শেষের হাওয়াতে। আমি ইচ্ছে করেই বক্ষবন্ধনীতে আটকে রাখিনি আমার দুটি সাদা কবুতরকে। আমি উন্মুক্ত করেছি আমার শ্রোণিদেশ। এভাবেই আমি এক নগ্নবতী হয়ে অপেক্ষাতে আছি। আমি তাকিয়ে আছি দুর আকাশের নিকে। জোনাক জ্বলছে। একটু বাদে চাদ শােনাবে তার আদিগন্ত ভালােবাসার গল্পকথা।
দূরাগত অশ্বরের ধ্বনি কি আমার কানে প্রবেশ করছে। আমি চোখ বন্ধ করছি। অন্ধকার ভেতর হঠাৎ আলাের ঝিলিক। তুমি কি এসেছাে প্রীতম প্রিয়াপাস, আমি উন্মুখ হয়ে আছি তোমার কণ্ঠস্বর শুনব বলে। আমার শরীরের প্রতিটি লোমকূপে এখন জেগেছে এক আশ্চর্য রােমাঞ্চ। তােমার দ্বারা স্পর্শিত হবে বলে আমার গােপন অঙ্গ হয়ে উঠেছে উন্মুখ!
আমি অর থাকতে পারছি না প্রীতম, দোহাই, তুমি এক্ষুণি এসে আমাকে অন্ধকারের এই রুদ্ধ কারাগার থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাও আলােকিত পৃথিবীর উদ্যানে।

ছাব্বিশ
আজ আমি কুইনটিয়া হয়ে যাব। আহা, গ্রেট সার্কাসের সেই লাবণ্যবতী মেয়েটি! মাঝে মধ্যেই, যে খেলার ছলে দেখিয়ে দিত তার নির্লোম যােনিদেশ। চারপাশের উৎফুল্ল দর্শকেরা আনন্দে অধীর হয়ে উঠত। তারা বারে বারে কুইনটিয়াকে আবেদন জানত, সে যেন আরাে বেশি যৌনতার ছলাকলায় পারদর্শিনী হয়ে ওঠে।
আজ আমি কুইনটি হয়ে যাব। অামার কষ্ট থেকে নির্গত হবে যৌনতার সেই সঙ্গীত, যা তােমার প্রতিটি অঙ্গকে উদ্দীপ্ত করবে। কাছে আসার সেই স্বর আমি পাঠিয়ে দেন বাতাসের বুকে, যা তোমাকে আরাে বেশি আমােদ দেবে।
আহা, আজ তো আমি কুইনটিয়া হয়ে তােমার সর্ব সঙ্গে নিজেকে নিবেদন করব। এতদিন পর্যন্ত যেসব আসন করতে আমি অপারগ ছিলাম, আজ অনায়াসে আমি তা অনুশীলন করব। আজ আমার এই, উজ্জ্বল রূপ দেখে তুমি অবাক হবে! তুমি গালে হাত দিয়ে ভাববে, এই কি আমার সেই শরৎ সকালের বন্দিতা? যার এক চোখে অলৌকিক আলাে খেলা করে, অন্য চোখে ধূসর অন্ধকার!
ওসব আস্ত আমি ভুলে যাব, ‘আজ আর কোনাে রোমান্টিকতা নয়, নয় শব্দের সহস্র উৎসার। আজ আমি ভীষণ ভীষণ শরীরী হতে চাই।

সাতাশ
ভালাে লাগে না, ভালাে লাগে না বর্ষামুখর এই দিন। ভালাে লাগে না জুই-এর সুবাস; ভালাে লাগে না নিজেকে আদর করার প্রতি ভালাে লাগে শুধু তোমাকে, তোমার স্বেদ থেকে উগত গন্ধ, তােমার বীর্যের অহঙ্কার, তােমার পৌরুষের অহমিকা।
তাইতো, হে সুরসুন্দর, বাইরে যখন টাপুর টুপুর নুপূর দিনে বর্ষারানির কণ্ঠস্বর, যেন আমি একাকিনী বসে আছি আমার বন্ধ আবাসের মধ্যে। সোঁদা গন্ধ এসে আমাকে আদ্ভুত করছে। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি, অদ্ভুত শীতল একটা রসধারা ক্রমশ নিম্নগামী হচ্ছে। নির্গমনের পথ খুঁজে পাচ্ছে না সে। জেগে উঠছে সংশয়।
তুমি আসবে তাে প্রিয়তমা

আঠাশ
যদি আমার মৃত্যু হয়, প্রীতম, তুমি আমার স্মৃতিতে শােক কবিতা লিখাে না কখনো। তুমি আমার সমাধিভূমিতে জ্বেলাে না নিঃসঙ্গ কোনাে প্রদীপ। তুমি শুধু মনে রেখাে, একদা আমি ছিলাম তোমার খেলা খেলার একমাত্র সঙ্গিনী!

উনত্রিশ
আমি স্ব-ইচ্ছায় বন্দিনী হয়েছি তােমার কাছে। এই তো আমি আমার অহমিকাগুলিকে তুলে রাখছি চন্দন কাঠের বাক্সে। আমার সমস্ত অহঙ্কারকে আমি নির্বিষ সাপিনী করে দিয়েছি। আমার তিতিক্ষা, আমার তিয়াস, আমার আকাঙক্ষা—সব কিছু আমি সাজিয়ে রেখেছি রূপার রেকাবিতে।
কখন তুমি আসবে?—আমি সারাক্ষণ একলা বসে আছি বাতায়ন পথ। দেখতে দেখতে সকাল গড়িয়ে বিকেল হল। গােধূলির রক্তরাগে পৃথিবী সেজে উঠল নববধূর সাতে। তুমি এখনও যেন এলে না প্রিয়তম?

ত্রিশ
মনে করাে, আমরা সেই অলৌকিক জলপ্রপাতের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। চারপাশে দিগন্ত বিস্তৃত ফুলের বাগান। এখন বসন্তকাল। তাই হলুদ ফুলে যৌবন এসেছে। তুমি মাঝে মধ্যে আমাকে ভয় দেখাচ্ছো। তুমি দূরে চলে যাবার ভান করছো। কিন্তু আমি জানি, আমার এই শরীরের স্পর্শ এবার যে পুরুষ পেয়েছে, সে জীবনে কখনাে আমাকে ভুলতে পারবে না।
যা, মাঝে মধ্যে সে হয়তাে স্বমেহনে মেতে উঠবে। অন্য কোনাে পুরুষের কাছে নতজানু হয়ে ভিক্ষা করবে সমকাম। কিন্তু শেষ অব্দি তাকে আবার আমার কাছেই ফিরে আসতে হবে। নিজের ওপর ‘তখানিই অহঙ্কার আছে আমার।

একত্রিশ
দীর্ঘ একটি রাত ধীরে ধীরে অবসিত হয়ে যাচ্ছে। আমি বুঝতে পারছি, একটু বাদে নিশার অন্তিম প্রহর ঘনিয়ে আসবে। এখনও সময় আছে, হে প্রিয়, আমাকে তুমি আর একটু বেশি আদর দাও। প্রথম প্রহর থেকে আমাদের মধ্যে যে খেলা শুরু হয়েছে, এখনও তার শেষ বাঁশি বেজে ওঠেনি। তুমি কি এখনই ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে উঠেছে প্রম? এই তোমার পৌরুষের অহমিকা? মাত্র ক’টি নিঃসরণ তোমাকে এতখানি ক্লিন্ন করেছে কেন ?
এখনও আমার মনের অরণ্যে সাউদাউ তুলছে বাসনার আগুন। বলাে, তুমি ছাড়া আর কার কাছে আমি যাব ? শেষ অব্দি আমি কি এক দ্বিচারিণী হৰ!

বত্রিশ
ওলাে তােরা চলে যা, তােরা এভাবে আর দেখাস না তােদের সবকিছু। আমার দুষ্ট প্রীতমের মন পাল্টে যেতে পারে।
একি! তুই কেন এমনভাবে পৃথুলস্তনা হয়ে দাঁড়িয়ে আছিস ? আমি জানি, তােদের বাদামি বৃন্ত থেকে ঠিকরে আসে অহঙ্কারের আলােকশিখা। তুই এখনই সেটিকে আবৃত কর বন্ধনীর আড়ালে। ভাগ্যিস প্রীতম এখন নিদ্রিত। ঘুম ভেঙে সে যদি চোখের সামনে তােকে দেখে তাহলে তাের ওপর আঁপিয়ে পড়বে এক ক্ষুধার্ত বাঘের মতো। যে কত দুস্থ আর লম্পট সে খবর আমার থেকে বেশি আর কে রাখে।
তুই চলে যায় এখন অন্তরালে।
সই, তুই কি আমার সাথে শত্রুতা করবি? তবে কেন এইভাবে তাের স্ত্রী-অঙ্গকে প্রকটিত করে দাঁড়িয়ে আছিস ? পাতলা আবরাণে এমনভাবে ঢেকে রেখেছিস, যেন শিমুল তুলাে। ফুদিলেই উড়ে যাবে। আর তখনই প্রকাশিত হবে তার সুন্দর এই বিবরটি। তা দেখে আমার প্রিয় উজ্জীবিত হয়ে উঠবে। তাের ওখানে কিছু একটা করার জন্য ছটফট করবে তার হৃদয়। তার চোখে তখন আমি আর আগের মতাে সুন্দরী,থাকব না!
তােরা চলে যা, আমার প্রিয়তমের ঘুম ভাঙার সময় হয়ে গেছে। আমি চাই সে উঠে শুধু আমাকেই আদর করুক। আমার দিকে ছুঁড়ে দিকমুঠো মুঠো আদরকণা। আমি স্নান করব তার স্বেদে। আমি পরিপূর্ণ হব তার পৌরুষে। ওলাে তোরা এস্থান থেকে সরে যা। দেখছিস না, সুর ঘুম ভাঙ্গার সময় হয়ে গেছে!

তেত্রিশ
হায় সশ্বর; তুমি কেন এই পৃথিবীতে এত দুঃখ এনেছো ? তুমি কেন আমাকে প্রীতমের মতাে করতে পারােনি? আমি তাে সারাদিন ধরে আমায় প্রেমিক নাইয়াদ্দের সাথে সময় কাটাতে চেয়েছি। অ৷মি তাে চেয়েছি পৃথিবীর সমস্ত দুঃখ যন্ত্রণাকে ভুলে যেতে। তুমি কেন আমার মনকে অকারণে উদ্বেল করেছাে? তুমি কেন আমার হাতে পায়ে দিয়েছাে বাঁধন? কেন পৃথিবীর বুকে এত ছেনাল রমণীকে এনেছো? তারা চোখ থেকে কটাক্ষ আর স্তন থেকে যৌনতার তীর ছুঁড়ে মারে। তারা অকারণে বিদ্ধ করে পুরুষ হৃদয়। শেষ পর্যন্ত হেসে ওঠে শয়তানি হাসিতে।
তুমি কেন এই পৃথিবীতে শুধু একটি মাত্র শুদ্ধ সকাল আনােনি?

চৌত্রিশ
কামনামদির ঈশ্বরের কাছে এক পবিত্র প্রার্থনা লুকিয়ে আছে। আমরা প্রতিটি তিক্ত প্রহর কাটাব একা একা। আমাদের মাথার ওপর সমস্ত বসুন্ধরার বােঝা চাপানাে থাকবে। শেষ অব্দি আমরা অপেক্ষা করব সেই অন্তিম রাতটির জন্য। যে রাত আমাদের আরাে বেশি বাসনাতৃপ্ত করে দেবে। যে রাত আমরা অনুভব করব হৃদয়ের স্ততীতে । আহ, আমরা ফিরে যাব প্রাচীন সেই যুগে, অমির মনিরা পানে উন্মাদ হব! আমরা একে অন্যকে পরাবাে বিনি সুতাের মালা। আবেগের আতিশয্যে আলিঙ্গনকে করব আরাে প্রগাঢ়। চুম্বনের নতুন একটা অর্থ খুঁজে নেব। স্পৰ্শনকে দেব নতুনতর মাত্রা। এভাবেই অতিবাহিত হৰে ‘আমাদের সােহাগ সম্পৃক্ত নিশিকাল!

পয়ত্রিশ
তুমি কি এক নিশি ? এভাবে আমার সবকিছু হরণ করতে এসেছো। দেখছো না আমি একাকিনী শুয়ে আছি। আমার শরীরে কোথাও এতটুকু আচ্ছাদন নেই। আমি সম্পূর্ণ প্রসাধনহীনা। আভরনহীনা। তবুও আমার হৃদয় আছে, যার দাম কত কেউ তা জানে না।
তুমি কেন এক তস্করের মতাে এসে আমার হৃদয় চুরি করতে চাইছো? তুমি কি ভাবছে, আমি প্রতিরােধের প্রাচীর তুলব না চারপাশে? আমি তােমার বিরুদ্ধে ঘােষণা করব না আমার তীত্ৰম জেহাদ ? তুমি কি আমাকে এতটা অবলা বলে ভাবছ নাকি!

ছত্রিশ
এভাবেই একদিন গল্প শুরু হয়। বৃষ্টিস্নাত সকালের রূপকথা; শিশিরসিক্ত সকালের কবিতা—এভাবেই একদিন লেখা হয়।
মিনার্ভার চোখে জ্বলে ওঠে নীলছে আগুন। ভেনাস হাসতে থাকে। ব্যাস ভাবে, ‘আর একটু বেশি প্রগলভ হবে কিনা। ফোবিয়াসের শরীর তীক্ষ হয়ে ওঠে। হারকিউলিস দেখায় তার পৌরুষ। এভাবেই একদিন পৃথিবীর বুকে বসস্তু আসে। ভালােবাসার নতুন ছন্দ জেগে ওঠে।

সাইত্রিশ
না, এটিকে এবার ঘুমিয়ে পড়তে বলাে। ও অনেকক্ষণ রাত জেগেছে। বারে বারে আমাকে আক্রমণ করেছে। আমি বারে বারে আদর করেছি তোমার ওই উথিত পুংদণ্ডটিকে। আহা, দেখতে এই এতটুকুন হলে কি হবে, সময়ে সময়ে সে উচ্চতায় আকাশকেও ছাড়িয়ে যায়! স্পন্দন জাগে তার সর্ব-অঙ্গে। আমার মনের ভেতর সে জাগিয়ে তােলে ‘অদ্ভুত শিহরণ! মনে হয়, ওকে রক্তাক্ত করি। করি ক্ষতবিক্ষত। আমার দাঁতের স্পর্শ লেগে থাকুক ওর সবখানে। ও ঘুমিয়ে পড়ুক। না, এখনই ওর ঘুম ভাঙিও না। ঘুম ভাঙলে ও আবার দুষ্টুমি করতে শুরু করবে। থিওলিসের পুত্রের মতাে অসংযমী হয়ে উঠবে। আমি এখন আর পারছি না। ওহে, প্রিয়তম, দোহাই তােমাকে, তুমি এখন তােমার দুষ্টু ঘােড়াটিকে সামলাও। অনেকবার ও আমাকে জ্বালাতন করেছে। আহ, আমার স্ত্রী অঙ্গ এখন রক্তাক্ত, আমি এই একটুখানি বিশ্রাম নেব।
কথা দিচ্ছি, ঘুম ভেঙে গেলে আবার আমি নতুন উদ্যমে যােগ দেব তােমার এই যৌনতার খেলায়।

আটত্রিশ
পৃথিবীর সবথেকে সহজ কথা—“আমি তােমাকে ভালােবাসি’—বলতে গিয়ে হৃদয় কেঁপে ওঠে কেন ? পৃথিবীর সবথেকে সহজ কাজ—’কাছে আসা,করতে গিয়ে আমরা কেন কেঁপে উঠি?
আসলে আমার মনে হয় জানাে? সহজ কাজটা আমরা সহজভাবে করতে পারি না বলেই মনের ভেতর জমে ওঠে এত সংশয়! আমাদের হয় উন্মুখ হয়ে ওঠে। আমাদের মাথার ভেতর প্রশ্নের মিছিল। বলাে, বলাে কবে আমরা শুদ্ধ, শান্ত, স্পন্দিত দিনযাপনের অভিসারী হতে পারব?

উনচল্লিশ
মার্কারির কি সৌন্দর্য আছে? অ্যাপেলার আছে, তৃষা। লায়াসাসের আছে বিষন্নতা? কিউপিটকে কি আমরা কামনামদির বলতে পারি?
এদের সকলের কিছু আছে, সেইসবের সংযুক্তিতে আমি তৈরি হয়েছি। আমার সৌন্দর্য, আমার তিক্ততা, আমার সিক্ত আকাশ—এসব আমারই। আমি এমন এক কিশােরী, স্ফুটনােন্মুখ যৌবনা, যার সর্ব-অঙ্গে এখনও অপাপে ঢাকা। অচুম্বিত দুটি ঠোট, অস্পর্শিত যােনিদেশ, সবকিছু নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে আছি। আমি ঐশ্বর্যবতী। আমি অনুরাগিনী। আমি শুধু তােমার প্রেমিকা হব বলে উন্মুখ। তুমি তো জানাে না, কত নিঃশব্দ কান্না করে ঝরে শিশির হয়ে গেছে! কত নীরব অভিমান এখন জমাট পাথর।
তুমি এত নিষ্ঠুর কেন? তোমার কি হৃদয় হলে কিছু নেই? তুমি কি আরক্তিম প্রহরের বন্দনা সঙ্গীত গাইতে পারাে না? তুমি ভরে আসবে প্রীতম?

চল্লিশ
এসাে তােমাকে ঢেলেথিসাসের গল্প বলি। সারা পৃথিবীতে তার মতো স্বৈরিণী সঙ্গিনী আর কেউ আছে কি? সেই কবে রােম দেশে যে দেখেছিল পুথিবীর আলো। ছ-বছর বয়সেই যৌবন এসেছিল যার শরীরে। আহা, শেষ অব্দি যে রূপযুবতী ছেনালবতী হয়ে ওঠে। হয়ে ওঠে পথচলতি বারবণিতা। অনায়াসে চোখ থেকে যে ছুঁড়ে দিতে পারে বিদ্যুৎ চাহনি। বিদ্ধ করতে পারে পুরুষ খদ্দেরের হৃদয়। একরাতে অন্তত একশাে জনের সাথে সঙ্গত কাতে পরে অনায়সে।
মাঝে মধ্যে গালে হাত দিয়ে আমি ভাবি, এতগুলো অণ্ডকোশ নিয়ে খেলা করা, সেকি কম কথা! এতগুলাে পুংদণ্ডকে গ্রহণ করা, বীর্জরসে উল্লসিত হয়ে ওঠা, তবুও বিন্দুমাত্র ক্লান্তি জেগে নেই! প্রশ্ন জাগে—সে কি মানবী নাকি দেবকন্যা?
আমি কি তার মতাে হতে পারি না? আগ্রাসী এক রাজকন্যা! শুধু গ্রহন করব, বিন্দুমাত্র শ্রান্ত হয় না। আমার সামনে নতজানু হয়ে বসে থাকতে প্রনয়প্রার্থীরা। তাদের দিকে আমি ছুঁড়ে দেব শুধুই করুনা। তারা এসে মনুষ্যেতর জীবের মতাে আমার পা লেহন করবে। আমি উচু করে ধরব আমার পদপ্রাপ্ত দুটিকে। আমি তাদের মুখে আঙুলের কারুকাজ করে দেব। তারা আমার গোপন অঙ্গে হাত দেবার চেষ্টা করবে। আমি ঠোটের কােণে ঝুলিয়ে রাখৰ দুস্ট হাসির টুকরাে, ধরা দিতে গিয়েও শেষপর্যন্ত আমি বিদায় নেব রঙ্গমঞ্চ থেকে। চারপাশে নেমে আসবে নীরব নৈঃশব্দ্য। তারই মধ্যে বিধৃত হবে পুরুষ কষ্ঠের হাহাকার। তারা বলবে, হায় নারী, তুমি কি করে এত নিঠুর হলে ?

একচল্লিশ
ওকে আসতে দাও, দেখছাে না, ওর ঢুলুঢুলু চোখ। ওর স্পন্দিত অহঙ্কার। ওর হাতে শব্দের সীমাহীন সম্ভার।
ও একজন কবি। না, তােমার মতাে বীরত্ব জেগে নেই ওর মনে। রাজ প্রশাসনের সুষ্ট শিখরে ও কোনােদিন উঠতে পারবে না। অর্থ নিয়ে খেলতে পারবে না ছিনিমিনি খেলা।
ও নেহাতই নিঃস্ব, দুঃখী এক মানুষ। পৃথিবীর কাছে ওর পরিচয় নেহাতই অকিঞ্চিৎকনা। ও শুধু বুকের জলে কবিতা লিখবে। ও শুধু মনের বেদনাকে নীল আকাশের তারা করে উড়িয়ে দেবে।
ও এক নিঃস্ব হতভাগ্য কবি। ওকে আসতে দাও। ও এলে বসন্ত জেগে উঠবে। তিতির পাখির গান শােনা যাবে। আকাশ থেকে নেমে আসবে ঈশ্বরের আশীর্বাদ! রাশি রাশি ফুল ফুটে উঠবে চারপাশে। দোহাই, ওর পথে তােমরা কোনাে বাধার সৃষ্টি করো না।

বেয়াল্লিশ
এসাে, এসাে অ্যারিস্টোকোলেস, আমি তােমারই জন্য বসে আছি এই দ্রাক্ষাকুঞ্জে, একাকিনী। এসাে, এসাে আমার হৃদয়ের দেবতা। তুমি আমার মুখে নিষিদ্ধ আপেলের টুকরাে তুলে দাও। এতদিন আমি বালিকাসুলভ দিন কাটিয়েছি। এবার জেগে উঠুক আমার অদিম সত্তা। আমি নারীত্বের গৌরবে গৌরবান্বিত উঠি। আমি কামনামদিরা জগতের অধিবাসিনী হয়ে যাই। চোখের সামনে যেকোনাে বালক আসুক না কেন, আমি তাকে নিয়ে খেলি উন্মাদ খেলা। মুহূর্তের মধ্যে তাকে করি নিস্ররণ, তাকে বসাই আমার ওপর। তার শরীর, আহা, ঈশ্বরের এক আশ্চর্য উপহার যেন আমার হাতে এক তাল মাটি। তাকে নিয়ে আমি যেমন খুশি খেলা করব। আমি লেহন লেহনে তাকে অস্থির করে দেব। আমি তার সর্বত্র জাগিয়ে তুলব যৌবনের সুষমা।
আহা, এসাে, এসাে অ্যারিস্টোকোরেস, আমার হাতে হাত রেখে তুমি নরকের উপত্যকায় প্রবেশ করো।

তেতাল্লিশ
বিগত দিনের জন্য কোনাে অনুশােচনা নয়, যা হারিয়ে গেছে তার জন্য অনুতাপ করে কী লাভ ? সবসময় জানবে, এ জীবনে যা পাওনি, সেটা তোমার প্রাপ্য ছিল না। আগামী অনাগত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থাকে। অমি কথা দিচ্ছি, প্রতিটি ভবিষ্যৎ তােমার কাছে আরাে উজ্জল হয়ে উঠবে। তুমি মেতে উঠবে অনাস্বালিত আনন্দে। প্রতিটি আগামীকাল তােমার জীবনকে আরাে একটু বেশি সম্পৃক্ত করবে।
এ আমার শাশ্বত অঙ্গীকার!

চুয়াল্লিশ
এসাে, আমার এই বিভাজিকায় আঁকো তােমার চুমুর চিহ্ন।
এসাে, আমার এই বিবরে রাখাে তোমার অসংযমী হাত।
এসো, আমার এই নিতম্ব-গহব্বর তােমায় দণ্ডে আরাে একটু উজ্জীবিত হােক।
এসাে, আমি এক শরীর আগুন নিয়ে বসে আছি। আমি এক আকাশ তিতিক্ষাকে ধরে রেখেছি। আমার মনের ভেতর সমুদ্রের কোলাহল। আমার হৃদয় জুড়ে ঝােড়াে বাতাসের আর্তনাদ!
এসাে, আর বেশিক্ষণ আমি এভাবে একা বসে থাকতে পারছি না। তুমি এসে আমাকে নরকের এই বিবর থেকে উদ্ধার কর। তুমি কখন আসবে?

পয়ঁতাল্লিশ
ঈশ্বর, তােনাকে একখানি খােলা চিঠি লিখব আমি। মাঝে মধ্যে মনে হয় তুমি অবিবেচক, নির্মম এবং হৃদয়হীন। তুমি এভাবে পৃথিবীতে অশান্তি এনেছো কেন? কেন মানুষের মনে দিয়েছে বহুকামিতার আশ্বাস ? কেন পুরুষ এক নারীতে তৃপ্ত হতে পারে না ?
কেন প্রেমিকের মন শান্ত করার জন্য আমাদের সেজে উঠতে হয় মরুদেশীয় হারেমকাদের মতো? কেন তার সামনে মেলে ধরতে হয় রূপ এবং যৌবনের সহস্র উপাচার। যেন তার অশান্ত পৌরুষকে বারে বারে প্রশমিত করতে হয় বাসনায় আগুন জ্বেলে।
ইশ্বর, তুমি কি আমাদের শান্তি, শুদ্ধ, স্নিগ্ধ করতে পারো না? তুমি কি প্রেমকে করতে পারাে না শাশত? তার সর্ব অঙ্গে লেপন করতে পারাে না পবিত্রতর চিহ্ন? ‘তুমি কেন মানুষকে এভাবে অসংযমী করে দাও ?
ইশ্বর, একদিন, আজ অথবা আগামীকাল, আমি সত্যি সত্যি তোমাকে একখানি খেলা চিঠি লিখব।

ছেচল্লিশ
হায় উল্লাসিনী সঙ্গিনীরা! হায় গৌরবর্ণের অধিকারিণীরা! তােমাদের ঠোট কথা বলছে। তােমাদের চোখ চেয়ে আছে, তােমরা সবসময় জলছ বাসনার আগুনে। হায়, ভারতবর্ষীয় বারবণিতারা, মধ্যদেশ থেকে ছুটে আসা ললনারা, তােমরা সকলে কি এক আশ্চর্য জগৎ নির্মাণ করেছে। সেখানে শুধুই যৌবনের উন্মাদনা? সেখানে শুধুই সঙ্গমের অভিলাষ! কাছে আসার নিপুণ উচ্চারণ!
তােমাদের এই শারীরিক অহঙ্কারের সাথে আমি পাল্লা দিতে পারব না। আমার শরীর অতখানি উদ্দীপ্ত নয়। আমার যৌনতা অত তীক্ষ্ণ নয়। অল্পেতেই আমি হাঁপিয়ে উঠি। তাই হে, সুন্দরীরা, তােমরা আমার প্রিয়তমের চারপাশে একটি আশ্চর্য শৃঙ্খল রচনা করাে। সে যেন তোমাদের অতিক্রম করে অন্য কোথাওঁ, অন্য কোনাে কুঞ্জবনে কখনাে না যেতে পারে।

সাতচল্লিশ
আমি ভেবেছিলাম, তুমি আমার জন্য উপহার দেবে বৃন্দাবন। উপহার দেবে অলােকিত রাত। উপহার দেবে স্পন্দিত সকাল।
আমি ভেবেছিলাম, এই জীবনে আমিই হব তোমার পাত্রী এবং রক্ষিতা। তুমি যেমনটি চাইৰে, সেভাবে আমি আসব তােমার কাছে। কখনাে আমার শরীর থেকে নির্গত হবে চন্দন সুবাস। সদ্যজাতা আমি, বুঝি আকাশ থেকে খসে পড়া একটি অপার্থি তারা! বুঝি পথ। ভােলা এক স্বর্গসুন্দরী!
আবার কখনাে আমি সেজে উঠব কামবিলাসিনীর ছদ্মবেশে। আমার সর্বাঙ্গে আমি লেপন করৰ বাসনায় নির্যাস। আমি নিজেকে প্রকাশিত করব। আমার নানা আকাশ অভিসারী হয়ে উঠবে।
তােমার মনে দ্বিধা জাগবে। তুমি কোন্ রূপটিকে ভালােবাসনে? সকালের শিশির নাত, নাকি মধ্য রাতের কামনালিপ্ত ?
আমি জানি, তুমি দুটিকেই আপন করে পেতে চাইবে। কিন্তু তা তাে হবে না। সুন্দর বন্ধু আমার, প্রীতম আমার, তােমাকে বেছে নিতে হবে, মৃত্যু অথবা জিঘাংসা; জীবন অথবা উল্লাস। কলাে, তুমি শেষ অব্দি কার হাতে স্বেচ্ছাবন্দী হতে চাও?

আটচল্লিশ
তুমি কি আমার স্ননসিক্ত শরীরখানি দেখতে পাচ্ছাে? প্রীতম, আমি একটা ভয়ঙ্কর অন্যায় করেছি। আমি মনে মনে অনা একটি পুরুষকে ভালােবেসে ফেলেছি। জানতে চাও সে কে? প্রতিবেশী কেউ? ঈশ্বর অথবা শয়তান ?
না, এই জীবনে কিছু রহস্য থাকুক, না হলে জীবনটা একঘেয়ে হয়ে যাবে।
আমি মনে মনে তার সাথে সঙ্গম কছি। আমি রমণের আনন্দ পেয়েছি। আমি ভালোবাসার স্বাদ পেয়েছি।
প্রীতম, তুমি কি এই অপরাধে আমাকে অপরাধী করবে? আমি কি কখনাে তােমার ক্ষমা পাব না?

উনপঞ্চাশ
চারপাশে প্রসারিত আছে এক আকাশ উচু প্রাচীর। তার ওধারে অনন্তু জীবন। এদিকে বিকৃত যৌবন। আমি ভাবছি প্রাচীর টপকে ওপারে চলে যাব কিনা। ওখানে আছে এমন এক জগৎ যার সাথে আমার পরিচয় হয়নি। সেখানে বাসনা জেগে থাকে সর্বক্ষণ। সেখানকার মহিলারা হেঁটে যায় একাকিনী, নগ্ন হয়ে । সেখানে লুকিয়ে আছে যৌবনের উচ্ছাস।
আমি ভাবছি, একদিন, সত্যি সত্যি সেদেশের বাসিন্দা হয়ে যাব।

পঞ্চাশ
প্রীতম, তােমার কাছে আমি অতি সাধারণ। আমি বেশ বুঝতে পারছি, আমার ইচ্ছা এবং অনিচ্ছাগুলােকে তুমি আর আগের মতো দাম দাও না। আমার কুহক এবং ভালােবাসা, আমার সংলাপ এবং সংরাগ, তােমার কাছে বড় বেশি সাধারণ হয়ে গেছে।
আমি বুঝতে পারছি, ইদানিং আর তুমি আমাকে সেভাবে কাছে ডাকো না। আগে যেমন দেখা হলেই নিস্পেশিত করতে আমায়, আমার তুলতুলে বুকের মাঝে রাখতে তােমার সবল মাথাখানি, আমার গোপন অঙ্গে তোমার আঙ্গুলের পরশ—এখন আর সেভাবে তুমি আমাকে আদর করনা।
কেন,কেন প্রীয়তম, আমি কি তোমার কাছে বালি ফুলের মালা হয়ে গেছি?

একান্ন
এসাে, আলােকিত শরৎ সকালে তােমাকে আমি আমার গােপন কুঞ্জবনে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।
দেখছাে না, গাছেরা এখন যৌবনভারে আনতা। দ্রাক্ষাকুঞ্জে কেমন মােহিনী হয়ে উঠেছে। সেখানে বােধহয় অ্যালসিন্ সের পত্নীকে দেখা যাচ্ছে। সােনালি চুলের সেই মেয়েটি, যার
চোখের তারায় আগুনের উন্মাদনা—সে ফুল আরেটি।
ওর দিকে এভাবে দৃষ্টিক্ষেপ করাে না। তুমি বরং আমার দিকে তাও। আমি তােমার ভূষিত গহ্বরের জন্য সাজিয়ে রেখেছি এক পাত্র সুরা। প্রতিটি গাছ ফুল-ফল ভারে নত হয়েছে। আহা, মালবেরি কেমন গন্ধ ছড়াচ্ছে! শুনতে পাচ্ছে সে বলছে, এসাে, আমাকে গ্রহণ করো। তাকিয়ে দেখো, রক্তবর্ণের ফুলগুলি প্রস্ফুটিত হয়েছে। এখনই, তো কাছে আসতে হয়। এখনই তো এই বাগানের নিভৃত নিরালায় একে অন্যকে গ্রহণ করতে হয়।
এখানে আমি সযত্নে রােপণ করেছি, লবঙ্গলতাদের। শশার গাছগুলি আরাে সবুজ হয়ে উঠেছে। মাটি থেকে প্রতি মুহুর্তে ছাত্র জীবন রস সংগ্রহ করছে। বামনাকৃতির লেটুস পাতায় চড়ুই পাখির কিচির মিচির। এবানে রাত্রি নেমে আসে কামাতুর ভঙ্গিতে। আকাশ থেকে খসে পড়ে অদ্ভুত তারা। জীবন আরাে স্বাস্তপ্রদ হয়ে ওঠে। এখানে রসুনের যৌনকাতর গন্ধ ভাসে বাতাসে। পিয়াজ আরাে বেশি উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে। আমার এই বাগানে আমি অসংখ্য বুনাে ঝোপ রচনা করেছি। তারা ছােটোখাটো কুটির তৈরি করেছে। সেখানে একবার প্রবেশ করলে কেউ আর আমাদের দেখতে পাবে না। এসাে, হে দুরন্ত তস্করদের দল, নির্ধিধায় তােমরা আমাকে ভােগ করাে। আমি এমনভাবেই বহুভল্লভা হতে চাই। এসাে, আমি আর থাকতে পারছি না।

বাহান্ন
প্রীতমের উদ্দেশ্যেয় প্রীতম, তুমি তোমার লোভী হাত আমার উদ্যান থেকে সরিয়ে নাও। এখানে সর্বত্র অসংখ্য মানুষের ভিড়। তাদের মাঝে তুমি হারিয়ে যাবে। তুমি কেন এমন একটা কামনামদির অভিব্যক্তি করছো? তুমি কি জানাে না, তোমাকে আমি আর আরে মতাে ভালােবাসি না। এখন যেটুকু করি, তাকে আমার অভিনয় বলতে পারো।
আমার এই কথা শুনে আহত হয়েছাে তুমি ? কিন্তু আমার কিছুই করার নেই। যা সত্যি, তাকেই আমি নির্ধিধায় উচ্ছারণ করলাম তোমার কাছে।
হায় বীতম, আমার কথা শুনে তুমি চলে যাচ্ছে! এতদুরে চলে যেও না। যাতে আবার ফিরে আসতে না পারাে!

তিপ্পান্ন
মদিরা আরাে একটু ঘন হয়ে উঠেছে। পান করলে মাতালিনী বাতাস ছুটবে চারপাশে। পায়ের মাঝে কঁপন জাগবে। অত্যন্ত যৌবনদীপ্র ধানগুলাে সুর্যস্নানে মত্ত হবে। গলায় ঝুলবে প্রস্ফুটিত পুষ্পের মালাখানি। আহা, পৃথিবী আরাে বেশি তরুণী হয়ে উঠেছে। এখন এসাে, আমরা একসাথে নিষিদ্ধ আপেল ভক্ষণ করি। বাসনার উদ্যানে খেলা করি বালক বালিকার মতো!

চুয়ান্ন
নিষিদ্ধ শব্দ দিয়ে লেখা হােক একটি রূপকথা। তাদের মাঝে ছােট্ট একটু ফাক থাকুক। প্রতিটি শব্দ তার অন্তরের গােপন অভিব্যক্তিগুলিকে ব্যক্ত করুক। এভাবেই যদি অশ্লীল একটি কবিতা লেখা হয়, তাহলে ক্ষতি কি?

পঞ্চান্ন
কেউ কি আমার সরল স্বীকারোক্তিকে বিশ্বাস করবে?
কে আমার স্তনান্তরালে রাখবে তার মুখের পরশ ?
এসাে, আমি সেই পুরুষের জন্য অপেক্ষাতে আছি, যে এসে আমার আত্মার ঘুম ভাঙাবে। যে এসে আমার কানে কানে শােনাবে মহামিলনের মন্ত্রকথা। তার কাছে আমি নির্ধিধায় আমার সবকিছু উজাড় করে দেব। আমি শরীরের কোথাও আবরণের পরশখানি রাখব না। আমি বিনি সুতাের মন সযত্নে জড়াব আমার দেহাকাশে। কিন্তু সে আসবে কি?

ছাপ্পান্ন
হে নিশিকুটুম, তুমি তাে অনেকক্ষণ ধরে আমাকে ভয় দেখাচ্ছো। তুমি কেন তােমার মধ্যমাটি নিয়ে আমার শরীরের ওপর আঁকছ আঁকিবুকি খেলা? তুমি কি ইহুদিদের সেই সুন্দর নিয়মের কথা জানাে। এভাবেই তারা মধ্যমার সাহায্যে রচনা করে অসাধারণ দৃশ্যকাব্য। জীবনকে আরো মধুময় করে তোলে।
আমি তােমার আঙ্গুলগুলির দিকে তাকিয়ে আছি। আবার কখনাে তাকিয়ে আছি তোমার মুখের দিকে। তােমার এক-একটি আঙুল যেন বাসনার এক-একটি বর্ণমালা ! বিবাহিত জীবনের প্রতি তারা নিঃশেষে উৎসর্গ করেছে নিজেদের। তারা এসে আমার শরীরের সবখানে অদ্ভুত একটা পরশ জাগাবে। আমি তৃপ্ত হয়ে উঠব!

সাতান্ন
প্রীতম, অনেকদিন বাদে আবার তােমাকে মনে পড়েছে আমার। প্রকৃতি এখন বিষন্নতায় সুর তুলেছে তার ভাঙা বেহালাতে। বসন্ত দিন অবসিত হয়ে গেছে। দেখছে না বৃক্ষগুলি এখন নিষ্পত্র! সামনে নিদাঘ আসছে। এখন আর নেস্টক্সের কুঞ্জে পাখি গান গাইবে না। প্রিয়াম বড়াে একলা হবে। তিথানােস তাকিয়ে থাকবে তার প্রিয়তমের দিকে। রমণীরা বৃদ্ধা হবে। যেন দিন হবে অস্তগামী। শুধু আমি জেগে থাকব, একবুক তিয়াস নিয়ে। আমি কিন্তু এখনও কিশােরী বেলার গান শুনতে পাই। আমি কিন্তু এখনও সেই অবুঝ বালিকা বয়সে ফিরে যেতে পারি। তােমার প্রতি এখনও আমার ভালােবাসা আগের মতােই অটুট আছে।

আটান্ন
না, এভাবে কাচের গ্লাসের মধ্যে বিশ্বাস ভাঙতে নেই। এভাবে প্রতারণা করতে নেই। আসছি বলে কথা দিয়ে দূরে চলে যেতে নেই। হে প্রীতম, তুমি কি দেখেনি আমার চোখ থেকে ঝড়ে পড়া অশ্রু? তুমি কি অনুভব করােনি আমার হৃদয়ের উৎসারিত বেদনা? তাহলে তুমি কেন এইভাবে আমাকে কষ্টের সাগরে ডুবিয়ে দাও!

উনষাট
বিশ্বাস রাখাে ভালােবাসায়, সতর্ক থাকো প্রতি মুহূর্তে, যাতে ঘৃণা এসে মুখ ঢাকতে না পারে। শ্রদ্ধাকে কখনাে অশদ্বায় পরিণত কোরাে না। তাহলে আত্মা বড়াে কষ্ট পাবে।

ষাট
ভালােবাসা দিয়ে অসংখ্য কবিতা লেখা হয়েছে রাতের পর রাত জেগে জেগে। আমি এক অকিঞ্চিৎকর কবি, নতুন কোন শব্দ সারে তাকে সাজিয়ে তুলব?

একষট্টি
তুমি কেন আমার বিরুদ্ধে অভিযােগ করেছো? তুমি কেন বলেছাে, আমি তােমাকে নিয়মিত আরাম দিতে পারছি না? এই তাে আমি আমার বক্ষবন্ধনী খুলে ফেললাম। এই তাে আমি আমার স্তনবৃন্তে জাগলাম কাপন।
এই দেখাে, আমি আমার কটিবাস ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিলাম। এখন আমি নগ্নিকা। বলাে, তুমি কীভাবে আরাম চাইছাে? শীতকালীন রােদ্দুরের মতাে? বসস্তুকালীন সান্ধ্য বাতাসের মতাে? নাকি আমি হব ঝুলন্ত ফল, তুমি আমাকে চোষণ করবে। আমি হাত দুটি তুলে এক কামনামদির ভঙ্গিমাতে তােমার দিকে তাকিয়ে থাকব। তুমি ঘােটক হয়ে আমার ওপর চেপে বসবে। আমি শিশিরে শ্নাতা হব। হিম কুয়াশায় ঢাকব আমার মুখ। বিষা পাখির মতাে দূর আকাশে উড়ে যাব। নাকি আমি হব জলপিয়াসী রাজহংস।আমি হব তৃষ্ণার্ত দাঁড় কাক কিংবা আমি হয়তাে এসব কিছুই হব না। আমি হব এমন এক মেয়ে যে কবিতা ভালােবাসে, যে সর্বক্ষণ তার প্রেমিকের সাথে নিজেকে মিলিয়ে মিশিয়ে একাকার করে দিতে চায়।
প্রীতম, কেন মনে জাগছে সংশয় ? শেষ অব্দি তুমি আমায় ভালােবাসবে তাে ?

ৰাষট্টি
ঘুমন্ত কুকুররা নিরাপত্তার বলয়ের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। উদ্দানে এখনও জেগে আছে সিলিয়াস। এরিগনের কাছে পৌঁছে গেছে তার শুভ সংবাদ। আহা, আকাশের বুকে জাগতে থাকা ওই কুকুর-তারাটি, আর নীহারিকাপুঞ্জ। ভিরগাে, এরিগনের পিতা হকারণ এখনও জেগে আছে। সে এক মেষপালকের ভূমিকায় হয়েছে অবতীর্ণ। তার প্রিয় কুকুরটি—মারিয়া, এখনও পাহাড়া দিচ্ছে, তখন সকাল হবে তাই আপেক্ষাতে। সবখানে এত অন্ধকার কেন? এসাে, আকাশের দিকে আমরা তাকিয়ে থাকি। আমরা অনেকের সাথে পরিচিত হই। দেখা যাচ্ছে একটির পর একটি নক্ষত্রকে। তারা আকাশকে আলোকিত করে তুলে। পৃথিবীর বুক থেকে সকল অন্ধকার দূরীভূত হয়ে গেছে। এসাে প্রিয়, তুমি আমার কাছে এসাে, আমি তােমাকে অনন্ত জীবন দেব।

তেষট্টি
এটাই যথেষ্ট নয়। আয়ে অনেক কিছু  বাকি রয়ে গেছে। এখনও এমন অনেক আদর করা হয়নি যা মনকে ভরিয়ে তুলবে আশ্চর্য আনন্দে নিদাঘকালীন খরা জেগেছে চারপাশে। বৃষ্টির প্রতীক্ষায় আমরা বুঝি এক তিয়াসি চাতকপাখি। আর্তনাদের শব্দে ধেয়ে আসছে তৃযার । চারপাশে সামাল সামাল রব উঠেছে। বরফের পিণ্ডগুলাে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। আমি তাকিয়ে আছি, অনিবার্য সেই বিপর্যয়ের মধ্যে একা, নিদহারা। আমি জানি না, তখন তােমার আশ্বাসী হাত এসে আমাকে একটুকরাে নীড়ের সন্ধান দেবে কিনা! কখন আমি ওই শ্রদ্ধেয় ঈশ্বরের কাছে পৌঁছতে পারব?আমি জানি না, কবে পিরামিডের ভেতরে আত্মগোপন করার সুযােগ মিলবে আমার ? এখনও আমরা কি এইভাবে নিলাজবর্তী হব?
এখনও তুমি আসবে না তুমি এসে তােমার পৌরুত্ব দিয়ে আমাকে আচ্ছাদিত করবে না। তুমি কি শােনাবে না অভয়ের মন্ত্রমালা?

চৌষট্টি
পৃথিবীতে কোনাে কোনাে অনুভূতি আছে, যাকে সাবধানে ঢেকে রাখতে হয়। সহসা তাদের মুখ উন্বাস করতে নেই। তারা অত্যন্ত কোমল, ছােট্ট বালিকার অভিমানের মতো। পৃথিবীতে এমন কিছু অনুভূতি আছে, সবসময় যাদের ঢেকে রাখতে হয়।

পঁয়ষট্টি
আহা, এই মুহূর্তটিকে আমরা সুন্দর করে তুলব! আমরা আরাে বেশি তিয়াস জাগাব। আমাদের আচরণকে করব কন্ধ। কামনামনির ড্রোব থেকে ঝরে পড়বে কাছে আসার তীব্রতম। বাসনা । তবেই তাে এই মুহূর্তটি রণযােগ্য হয়ে উঠবে।

ছেষট্রি
এসাে আমরা একসাথে সবকিছু করি; আনন্দ, হাসি, গান—জীবনের এক-একটি উৎসব। আমরা পায়ে পা রেখে হেঁটে যাই স্বর্গের উদ্যানে। আমরা সমুদ্র স্নান করি। আমরা দীর্ঘ দীর্ঘতম রাতগুলিকে আরাে কামনামদির করে তুলি। তবেই আমাদের আত্মা শাস্তি পাবে।

সাতষট্টি
এভাবেই এক-একটি ভালােবাসার শব্দ উচ্চারণ করতে হয়। না, পেশাগত দক্ষতায় নয়, অভিমানের আন্তরিকতায়। এভাবেই কাছে আসার এক-একটা ছন্দকে তুলে ধরতে হয়। যাতে তারা আরাে বেশি ক্ষয় হয়ে ওঠে। অনন্ত নক্ষত্রবীথির মধ্যে দিয়ে এভাবেই হেঁটে যেতে হয়। হাতে হাত রেখে আর পরস্পরকে আলিঙ্গনের তীব্র প্রতিজ্ঞা করে।

আটষট্টি
গ্রামীণ সভ্যতার যুগে ফিরে গেছি আমরা; শহর হারিয়ে গেছে। হোমারের যুগের সেই বাক-বিন্যাস জেগে উঠেছে। জেগে উঠেছে তীব্রতম তিয়াস। নারী পুরুষকে ভালােবাসবে। পুরুষ নারীর প্রতি জ্ঞাপন করবে সীমাহীন সখ্যতা। এভাবেই রচিত হবে এমন এক স্বর্গ, ভাষায় যাকে বর্ণনা করা সম্ভব নয়!

উনসত্তর
ট্রোজান এবং তানেরানের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে আমার। সেই মহাযুদ্ধের রণসঙ্গীত কানে ভেসে আসছে। প্যারিস হেলেনকে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। যদি না পালাতাে, তাহলে হােমার কি ইলিয়াড লিখতে পারতেন? প্রীতম, ভেবে দেখাে তো ট্রোজান যুদ্ধের সেই রণােম্মাদ মুহুর্তগুলির কথা। কোরাসে লিখেছিলেন—হেলেনের সৌন্দর্য, মানুষের চোখকে অন্ধ করে দিতে পারে। এভাবেই তাে একদিন প্রেমের জন্য লড়াই হয়েছিল। সবকথাই মনে পড়ে যাচ্ছে। মন পড়ে যাচ্ছে আসিরাসের প্রিয় পৌৱের কথা। যুদ্ধবিদ্যায় যে ছিল অসাধারণ। মনে পড়ে যাচ্ছে কত রূপযুবতীদের কথা। ইউলিসিসের পাতায় পাতায় তাদের সৌন্দর্যের ছবি আঁকা হয়েছে। যখন আমরা ক্যালিপসে পড়ি, আটলাসের সেই সঙ্গিনী কন্যাটির কথা জানতে পারি, এখন বুঝতে পারি সে কেন এত সুন্দরী হয়ে উঠেছিল। সে একাধিক পুরুষের মন মজিয়েছে। শেষ পর্যন্ত তার গর্ভে সন্তান এসেছে। জিলিসিহানের বীর্যরসে স্নান করেছে সে।
মনে পড়ে যায় নাউসিকার কন্যার কথা। সে-ও তাে অসামান্য রূপবতী, তার যৌবন কোনােদিন অস্তমিত হয়নি। সে ভালােবেসেছে একাধিক যুবককে। শেষপর্যন্ত ভালােবাসার বগিনী ভূমিকাতে সেজে উঠেছে। আহা, ইউলিসিসের সেই দিনগুলি, আর কখনাে কি এই পৃথিবীতে ফিরে আসবে?

সত্তর
বসন্ত কি চিরদিন একইরকম থাকে। প্রতিদিন কি একইরকমভাবে বয়ে যায় বাতাস ? হে নিশিকুটুম, তুমি কি একইরকমভাবে এখানে থাকতে পারবে অপেক্ষারত? আমি এক্ষুণি আসছি, তুষারে স্নান সেরে, জােরের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে….

একাত্তর
আজ সকালটা একেবারে অন্যরকম। চারপাশে শুরু হয়ে গেছে বিশৃঙ্খলা। মনে হচ্ছে, পৃথিবী বুঝি আজ দ্রাক্ষারস পান করে মাতাল হবে। ধুম উদগরিত হবে। জেগে উঠবে পাশ প্রবৃত্তি। আজ আর আমরা কেউ কাউকে ভালােবাসতে পারব না। আজ শুধু এক অনিয়ন্ত্রিত খেলায় সময় কেটে যাবে।

বাহাত্তর
ওই আম্রকুঞ্জে চলাে। চলাে দ্রাক্ষাবাগিচায়। সেখানে প্রকৃতি আর মানুষ মিলেমিশে একাকার। সেখানে গেলে আমরা জীবনের নতুন গল্পকথা শুনতে পাব।

তিয়াত্তর
প্রিয়তম আমার, তুমি এই উদ্যানের মহাসংরক্ষক। তুমি দেখাে, কোনাে দুস্কর যেন। সেখানে অনধিকার প্রবেশ করতে না পারে।

চুয়াত্তর
নিজেকে নিজেই আমি বুঝতে পারি না। মাঝে মধ্যে মনে হয় আমি সুদুরতমা। আমার মনে আবেগ আছে, আছে অভিমান। কখন কোনটা প্রকট হয়ে ওঠে, আমি তা নিজেই ধরতে পারি না।
নিজেকে নিজেই আমি বুঝতে পারি না। মনে হয় আমি এক কুয়াশাচ্ছন্ন অন্ধকার রাত!

পঁচাত্তর
ওভাবে তুমি আমার দিকে তাকিয়ে থেক না। ওভাবে তাকালে বুকের ভেতর কাপন জাগে। তুমি সােজাসুজি আমাকে অবলােকন কর। তােমার চোখ থেকে ভালােবাসার তীব্রতম আকুতি ঝরে পড়ুক। তাহলেই আমি তৃপ্ত হব।

ছিয়াত্তর
দেখাে, যেন মদমত্তে গলিত নারী আর পুরুষ চলেছে পাশাপাশি। একে অন্যকে দিচ্ছে সীমাহীন ভালােবাসা। হে দয়িত, এখন কি এভাবে অভিমানে দূরে থাকতে হয় ?

সাতাত্তর
আজ হঠাৎ জােছনার কথা মনে পড়ে গেল আমার। জুপিটারের কথাও মনে পড়েছে। জুনে, সামস আর মায়াসিনরা আমার মনের আকাশে এসে ভিড় করেছে। মনে পড়ছে মধ্যযুগীয় রাজকীয় ঐতিহ্মের কথা। তখনকার ভালােবাসার আকাশ ছিল দিগন্ত ছোঁয়া। একটির পর একটি রসিনী’ নায়িকা মদমত্তে কাপাত পৃথিবীকে। হৃদয় মাঝে কামনার আগুনশিখা জ্বেলে দিত তারা। ছিল তারা স্বৈরিণী। মুহুর্তের ভগ্নাংশে পুরুষ বন্ধু পাল্টাতাে। তবুও তাদের প্রতি আমাদের কোনাে ঘূণা নেই। বরং আমরা বলি, তারা ছিল বলেই তখন মানুষ এত বীর হতে পেরেছিল!

আটাত্তর
আমি এখন আর একটু শিথিল হয়ে গেছি। আমার যৌবন আগের মতাে আর লােভাতুর নয়। এখন আমি নিজেকে নিজেই আদর করি। এখন আমি মেতে উঠি এক বিকৃত স্বমেহনে।
তিতাসের কথা মনে পড়ে যায় আমার। প্রিয়াম এসে মাঝে মধ্যে স্বপ্ন দেখা দেয়। জাতি অবস্থায় নেস্টারের সাথে হঠাৎ হঠাৎ আমার দেখা হয়ে যায়। তারা সবাই আমাকে বলে, তুমি এখন যথেষ্ট বড়াে হয়েছে। তােমাকে প্রবীণা, প্রস্রবর্তী বলা যেতে পারে। হায় রমণী, তােমার চোখের সেই হীরক দ্যুতি কোথায় হারিয়ে গেছে। তোমার স্বভাবে জেগেছে একটা অদ্ভুত স্থবিরতা। তুমি কি এইভাবে কবরের অন্ধকারে অর্ধতি হয়ে যাবে?

উনআশি
পৃথিবীর সমস্ত দেবতা এবং দেবপত্নীদের উদ্দেশে বলছি, তোমরা আমাকে আবার যৌবন দিনে ফিরিয়ে নিয়ে যাও। এখনও একক কালােবাসা রয়ে গেছে আমার। এখনও আমার অনেক আশা পূর্ণ হয়নি। হে ঈশ্বর, আমি যেন আবার এক রঙ্গিনী সুন্দরী যুবতী হতে পারি!

আশি
প্রীতম, নিভে যাবার আগে শেষবারের মতাে জ্বলে উঠুক প্রদীপশিখা। উদ্দীপ্ত অহঙ্কারে আমি তোমাকে স্পর্শ করি। তুমি আমার যৌবনের কুঞ্জবনে এক অজানা আগন্তুক হয়ে প্রবেশ কলে। তুমি আমার হৃদয়ের পর্ণকুটিরে মাত কাটাও।
প্রীতম, নিভে যাবার আগে শেষবারের মতাে জ্বলে উঠি আমরা!

একাশি
এসব কথা বললে নিজেকে কেমন যেন নির্বোধ বলে মনে হয়। মনে হয়, এর মধ্যে প্রতারণার গল্প আছে। এসব কথা বলতে পারে পথচলতি কেশর মেয়েদের দল। যারা কাচের চুড়ির মতাে শপথ ভান্তে। আমার মুখে একথা মানায় না। আমি যখন কোনাে কথা বলব, ‘তার মধ্যে বিশ্বাস থাকবে, থাকবে আন্তরিক, বাজবে আত্ম নিবেদনের সুর, তা না হলে কথাদের আসল কোনাে মানে থাকবে না।

বিরাশি
জীবন বহমান থাকবে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে। প্রীতম, আমি কথা দিচ্ছি, আগামী জন্মে আমি তােমাকেই ভালােবাসব।

তিরাশি হায় প্রসপেক্টাস! অনেকদিন বাদে আজ হঠাৎ তােমার কথা মনে পড়ে গেল আমার। কত বছর আগে এক দেবমন্দিরের অলিন্দে তোমার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল। তখন সবেমাত্র দেখা দিয়েছে প্রভাত সূর্যের ‘আলিম্পানী তখন আমি এক মধুমঞ্জরী। আমার হাতে পুষ্পমালি। আমি চলেহি দেব অনুধ্যানে।
তুমি ক্ষণিক আমার দিকে তাকিয়েছিলে। আমার মনে হয়েছিল কোথাও বােধহয় একটা। ভূমিকম্প ঘটে গেল।

চুরাশি
কোন সংবাদ তুমি নিয়ে এসেছে আমার কাছে? আমি তাে এতক্ষণ এই খবরটি শােনার জন্যই তৃষিতা ছিলাম। রাত্রি গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে। আমার উষ্ণ বুকের মাঝে লেগেছে অবিশ্বাস। আমার বাসনার ফুল অকালে ঝরে গেছে। আমি তোমার ওই উখিত দণ্ডটির স্বপ্ন দেখতে দেখতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি নিজেই জানি না।
এসাে প্রিয়তম, তুমি যখন মাঝরাতে আমার ঘুম ভাঙ্গিয়েছে, তখন আমাকে তৃপ্ত করার কঠিন দায়িত্ব তােমাকে নিতেই হবে। আমি জানি, তুমি স্বাস্থ্যবান। তুমি দৃঢ় লিঙ্গের অধিকারী। তােমার সংস্পর্শে পৃথিবীর সমস্ত নারী সুখী হয়ে ওঠে। তুমি আর একটু কাছে এসো। তুমি আমাকে ভালােবাসার অ-আ-ক-খ শেথাও। তুমি আছাে, তাই এখানে হাজার সূর্যের আলাে! আমি জানি, আজ সারারাত তুমি এভাবেই আমার সাথে যৌনতার এক মধুর খেলায় মেতে উঠবে। ধীরে ধীরে হাত গভীর থেকে গভীরতর হবে। তারাদের গল্পকথা শেষ হবে। পুব আকাশে আলাে জাগবে। তখন ফুরােবে না আমাদের মৈথুন। তখনও ‘আমরা প্রথম রাতের মতে নিবিড় আশ্রষে একে অন্যকে আলিঙ্গন করার চেষ্টা করব।

পচাশি
প্রিয়তম, তুমি কি আমার অভিভাবক হবে? তুমি কি জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এক নিবিড় বন্ধনে আমাকে আবদ্ধ করবে তোমার মধ্যে কি থাকবে প্রভুত্বের অহমিক্স? আমি স্ব-ইচ্ছায় তােমার ক্রীতদাসী হতে পারি। দোহাই, তুমি আমাকে ফেলে অন্য কোথাও কখনাে যেও না!

ছিয়াশি
গোলাপের সাথে সখ্যতা পাতিয়েছিলাম, গােলাপ ঝরে গেল। শরৎকালীন ‘আপেলকে বলেছিলাম বান্ধবী হতে, নিদাঘ দিনে সে হারিয়ে গেল। বর্ষার বৃষ্টি বলেছিল, সহেলি হবে আমার। দেখলাম, সেও একদিন শেষ হয়ে গেছে। তাহলে, শেষ অব্দি আমি কার কাছে যাব? কোথায় আছে, সেই মহামানব, যে আমাকে অপরিমাপ্য ভালােবাসা দিতে পারবে?

সাতাশি
গল্পটা এভাবেই শুরু হােক হে আগন্তুক! তুমি তাে এক পর্যটক, দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়াও একা একা। তােমার পায়ে পথরেণু, তােমার মাথায় শিশির কণা। তুমি দেখেছে লোভ, তুমি দেখেছে রিরংসা, তুমি মানুষের ভালােবাসা দেখেছাে কি?
নীল আকাশের নিচে ঘুমন্ত এই পৃথিবী। ক্ষণিকের তরে নারী পুরুষের কাছে আসা। হে পর্যটক, তুমি কি জানাে এর অন্তরালে কী আছে? কতখানি আম্মনিবেন? কতখানি উন্মদিনা? কতটা তিয়াস?
জন্ম-জন্মান্তরে এভাবে কেন পুরুষ নারীকে ভালােবাসে এবং প্রত্যুত্তরে নারীও পুরুষকে দেয় অম) ভালােবাসা?
হে বিশ্বপথিক, তুমি কি এই রহস্যের আসল উৎস কোথায় তা জানো?

অষ্টআশি
এখানে একলা রচিত হয়েছিল আমাদের মিলন স্বর্গ। তখনও আকাশে ছিল জুলজুলে চাদ। বাতাসে ছিল নিবিড় জ্যোৎনা। তখনও আমাদের ধমনীতে বহমান ছিল উপ রুধির ধারা।
এখানে একদা ওই আতাগাছের নিচে আমরা সযত্নে রচনা করেছিলাম আমাদের সঙ্গ শঙ্কা। আমরা আবেগে খদ্রোখরাে কেঁপেছিলাম। ভালােবাসার সাগরে ভেসেছিলাম। একে অনাের হাতে তুলে দিয়েছিলাম আশ্লেষে রা ভালোবাসার উপহার।
আজ অনেকগুলাে বছর গেছে হারিয়ে। পৃথিবী আর একটু প্রবীণ হয়ে উঠেছে। আমরাও হারিয়ে ফেলেছি সেই প্রথম যৌবনের প্রগলভতা। এখন দেখা হয়, কিন্তু কথা হয় না। কথা। হলেও তার মধ্যে তারুণ্যের চিশতা নেই। এখন সবকিছুই কেমন যেন পেশাদারিত্বে ঢাকা।
তবু তার মাঝে জেগে থাকে প্রেম। বহ্নিমান চিতার আগুনের মতাে। সেই আগুন কখনাে নিবে না।

উননব্বই
প্রীতম, এই হল আমার সমাধি। একটু বলে এখানেই আমি শেষ আশ্রয় গ্রহণ করব। অথচ এখনও আমার মন অশান্ত। এখন আমি তােমার দিকে তাকিয়ে আছি তৃষিত চোখে।
আমার স্থির বিশ্বাস, মৃত্যুর পরে যে জীবন, সেখানে আবার নতুন করে শুরু হবে আমাদের মৈথুন ইতিহাস।
প্রিয়তম, দুঃখ করাে না, আমি আসছি। রক্ত গােলাপ হাতে নিয়ে তুমি প্রতীক্ষাতে থাকবে তো?
-এভাবেই বেঁচে থাকতে হয়। একরাশ মাটি থাকবে। থাকবে এগােছা ফুল।
হঠাৎ চেতনার খুনে লাল হবে সব।
প্রাক্-যৌবনে তােমার জীবন অভিধানে
থাকবে না কোনাে ক্লান্তি অবসর।
তারপর একসময়
শীতার্ত রাত কেটে যাবে, আসবে গ্রীস্ম
তােমার জীবনে আসবে ক্লান্তি
তুমি বলেছিলে অবশেষে মৃত্যু আসবে,
তারপর বর্ষার প্রথম বৃষ্টি এসে ধুইয়ে দেবে
তোমার সব বিভ্রম দ্বন্ধ;
এভাবেই প্রাণবন্ত করবে
তােমার-আমার আগামী অস্তিত্বকে।
গত বর্ষার কৃষ্ণপক্ষের উঁদ জেগে আছে আকাশে এক তারা হয়ে। রাত জাগা সেবিকার তাে তুমি তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
কত রাত এভাবে তুমি একা একা জেগে থাকবে? কীসের প্রতীক্ষায়? আজ তৃতীয়া, সেদিনের কথাগুলাে স্পষ্ট মনে পড়ছে।
ঝাউবনের পাশ দিয়ে নদীর কূলে কে যেন চলেছে একাকিনী
অামারও ঘুম ভাঙে রাতে, চুপি চুপি উঠে আসি, বসি জানলার পাশে।
সিড়ি বেয়ে খােলা আকাশের নিচে দুর্দাড়াব সে বয়স হারিয়ে গেছে।
জীবন এখন অর্ধগােলাপ। যতদূর দেখা যায় দেখি পশ্চিমদিকে ফেরানাে তোমার মুখ।
আগের মতােই প্রদীপ্ত তুমি? অথবা হতে পারে এক অদৃশ্য যাঁধের আড়ালে একা বসে আছো।
আজোও মাঝে মধ্যে দিকবলয় থেকে তােমাকে আসতে দেখি।
শিশিরে স্নান করেছাে তুমি।
এক-এক রাতে তােমার এক-এক অভিসারের রূপ দেখতে দেখতে আমি অবাক হয়ে যাই। আমার কেবলই মনে হয়, তুমি যেন এক নারী, প্রেমিকা হয়ে আকাশের বুকেই সমাধি পেতে চাইছো।
এই কৃষ্ণপক্ষের ভােরে নিশাস্তিকার আলাে আমি মেখেছি গায়ে। আহা, সূর্যের দিক চক্রবালের নিচে আশ্রয় নেব। যেমনভাবে প্রতিটি পুরুষ-প্রেমিক শেষ পর্যন্ত মিশে যায় তার। শ্রেমিকার সাথে, তেমনভাবেই আমি একদিন তােমার রজঃ ঘাম রক্তের মধ্যে মিশে যাব।
শুধু জেগে থাকবে আমার আকণ্ঠ তিয়াস!

চারপাশে নীল বিষণ্ণতা

এখনও চারপাশে নীল বিষমুতা। নীলকণ্ঠপাখি উড়ছে দূর আকাশে। তার ধূসর জানায়। আড়ানাে আছে জীবনের বিন্যাস। উড়তে উড়তে চলে যাচ্ছে সে ছায়াপথের দিকে। পরমকে ভালােবেসে আমিও এভাবে নীলকণ্ঠ পাখি হতে চাই। হরিয়ে যেতে চাই নীল বিতরি বিষে!
হায়, আজও সমুদ্র ভাঙ্গে ঢেউ; আজও সােনালি ডানার চিরকূট উড়ে যায় শূন্য হাহাকারে। আজও কান্নার কাতরতা চোখে পড়ে। সমস্ত সস্তায় জড়িয়ে থাকে রূপসারি বানের লিঙ্ক জোড়া মাঠ!
তুমি এক নীলকণ্ঠ পাখি, হিম অরণ্যের অন্ধকারে ছােয়ছায়া প্রতিদিন হেটে যায় একা একাকি নিঃসঙ্গ নির্জনতার সাথে তুমি কথা বলো।
তােমার ঠোটে ফুলে থাকে শব্দের বিস্তার।
বর্ণমালা, দুঃখিনী বর্ণমালা আমার।

Please follow and like us:

fb-share-icon


Tags: , , , , , ,

Comments are closed here.