ভালােবাসা ভালােবাসা – প্রফুল্ল কুমার পাত্র

February 17, 2021 | By Admin | Filed in: বিখ্যাত লেখকদের সাহিত্যে যৌনতা.

ট্রেনটা স্টেশন পেছনে রেখে হর্ণ দিয়ে বেরিয়ে গেল। এসপ্রিট ক্যাডেনেভ লক্ষ্য করল বেশীর ভাগ যাত্রী ঐ স্টেশনে নেমে গেছে। তার বিপরীত দিকের একটা আসনে একজন রুপসী তরুণী বসে আছে। শিল্পীর চোখে সুন্দরটা বেশ তাড়াতাড়ি ধরা পড়ে, কারণ এসটি শিল্পী।

সে ট্রেনে উঠেছে পেতু স্টেশন থেকে এবং ভােরের দিকে। তারপর একটু শোবার মত জায়গা করে নিয়ে এক ঘুম দিয়ে নেয়। ঘুম ভাঙতেই ধড়ফড় করে উঠে বসে, চোখ রগড়ে বাইরের দিকে তাকায় শিল্পী, রােদ্দুরে চারদিক ঝলমল করছে। | তরুণীও বেশ কিছুক্ষণ ঘুমিয়েছে, এখনও তার চোখে ঘুমের আমেজ, ঘুম ছাড়েনি চোখ থেকে।

কালাে লেসের পাড়ওলা একটা চাদর ছিল ওর গায়ে, সেটা খুলে ফেলে মাথায় এলাে সােলা চুলগুলাে নিয়ে খোঁপা করে হাত আয়নার মুখখানি দেখে, নিজেকে পরিপাটি করে ভব্যক্ত করে নেয়।

ভরা যৌবন যেন উথলে পড়ছে তরুণীর দেহ থেকে, বেশ পরিপুষ্ট দেহ, বাধভাঙ্গা যৌবনের মাধুরী। কটা চোখ দুটি যেন মিলন শতদল। লাল গালের ওপর কালাে তিলটা মেয়েটির মুখখানিকে ভারি করে তুলেছে। মেয়েটির ক্ষীণ কটি, উদ্ধত ও উজ্জ্বল দুটি বুক আর দাস্তানায় জড়ানাে দুটি পেলব হাত গােল গােল চোখে লােভীর কষ্ট নিয়ে এসপ্রিট যেন গিলছিল। বিধাতার সৃষ্টি কি অপরুপ! তার দানের শেষ নেই। যেখানে যেটি মানায় সেখানে সেটি অকৃপণ হস্তে দান করেছেন।

ছােট্ট ছেলে যেমন কৌতুহলী হয়ে চুরি করে ফাঁকে ফাঁকে দেখে, তেমনি এসটিও একই কায়দায় মেয়েটির সবকিছু লক্ষ্য করছিল।
ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট বের করল যার মধ্যে রয়েছে একটুকরাে রুটি। আরাে কিছু যেন থাকার কথা। মেয়েটি প্যাকেটটি উলটে পালটে খোঁজে, কিন্তু সেই জিনিষের পাত্তা নেই। মেয়েটির ঠোটে ফুটে ওঠে গভীর হতাশা।

এসপ্রিটের দেখে একটু কষ্ট হল। মেয়েটির প্রতি মায়ায় ভরে যাচ্ছিল তার বুক। তাড়াতাড়ি রাঙতা মােড়া একটা চকোলেট বার করে। তারপর মেয়েটির কাছে এগিয়ে গিয়ে বীরপুরুষের দীপ্ত ভঙ্গিতে বলে, মাদাম, মামজেল।
মেয়েটি উত্তর দেয়—হ্যা, মামজেল।
তার উত্তরে শিল্পী এসপ্রিটের মন অসহ্য উল্লাসে নেচে ওঠে। ঠোঁটে ফুটে ওঠে খুশীর রেখা। সদ্য গজানাে গোঁফ যেন তরঙ্গায়িত হয়ে ওঠে।
—মামজেল, কিছু একটা ভুলে এসেছেন তাে ? তার কথা ভুলে গিয়ে এই সামান্য চকোলেটটি গ্রহণ করুন।

প্রথমে একটু দ্বিধাবােধ করে তরুণী। তারপর, অপরিচিতের দান গ্রহণ করে এবং ধন্যবাদ জানায়। নিজের রুটিখানি দুজনে ভাগ করে খায়।
কত নদী, প্রান্তির পর্বত পার হয়ে ট্রেন ছুটে চলেছে দ্রুত গতিতে। রুটি খেতে খেতে দুজনে জানলার ফাঁক দিয়ে সেই দৃশ্য দেখে। পাহাড় আর পাহাড়, কোথাও তারা গায়ে গায়ে রয়েছে, কোথাও বা দুরে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে রয়েছে। ফলের বাগান, শান্ত পল্লী, কোথায় চেরী ফুলের সমারােহ। ফুলে ফুলে চারিদিক সাদা, যেন তুষার পড়েছে। মাঝে মাঝে চোখে পড়ছে প্রবহমান নদী, দপাশে বড়াে বড়াে ঘাসের শীষ হাওয়ায় দুলছে। দুরন্ত বাতাসে নার্সিসাস ফুল দলে দলে নাচছে।

একত্রে ভাগাভাগি করে এই সামান্য জলযােগের মধ্যে দুজনের ব্যবধান সরে যায়। নীরবতার এবং অপরিচয়ের আড়াল কেটে যায়। বেশ খােলা মনে দুজনে গল্প করতে থাকে।

এসপ্রিট নিজের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার বাসনার নব-পরিচিতা যাত্রী সহচরীর কাছে আত্মপরিচয় দেয়। সে কোথায় থাকে কষ্ট করে, যাবে কোথায়, এইসব । সা ব্যাফেলে থাকে, যাচ্ছে এখন গ্রেকােলে। সেখানে এক ধনীর বাড়ীতে কাজ পেয়েছে, বাড়ীর প্রত্যেকের ছবি অাঁকতে হবে। লোকটা দেখতে একদম বিশ্রী, ভারী কদর্য চেহারা, কিন্তু পয়সা প্রচুর। কাজের জন্য অনেক টাকা দেবে।

এইসব কথা বলার সময় শিল্পী এসপ্রিট হাতমুখ নেড়ে নানারকম অঙ্গভঙ্গী করে যাদের ছবি অাঁকতে হবে তাদের আকৃতি বর্ণনায় প্রয়াস করে, আর মেয়েটি হেসে লুটোপুটি খায়। ক্রমে দুজনের মধ্যে একটা স্বচ্ছন্দ বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে।
–আচ্ছা, আপনি যে কোন ছবি একে ফেলতে পারেন? বেশ কাজ আপনার, ছবি আকা। মেয়েটি জানতে চায়।
-হ্যা, মামজেল, কি নাম যেন আপনার? -লসি।
মামজেল লুসি গ্রেনােবলে দুটি দিন যদি আপনি থেকে যান তাহলে আপনার একটা ছবি আঁকতে পারি। ভারী খুশী হব। বলতে কি, যাদের ছবি আঁকতে যাচ্ছি সেই কদর্য কর্মের মধ্যে এ হবে এক আনন্দময় বৈচিত্র্য।

লসি সলজ্জ ভঙ্গীতে বলে—আপনার কথা রাখতে পারছি না বলে ভারী দুঃখিত। কারণ ক্লেরমোতে আমি নামব, অত দূর পর্যন্ত যাবার কথা নয়।
লুসি বলতে থাকে নিজের কথা। আইকম-এ একজন পদস্থ হাকিম সাহেবের বাড়ির সে গভর্নেস। খুব ছােটবেলায় মা-বাবা হারিয়েছে। আছেন কেবল খুড়াে আর খড়ি। আত্মীয় বলতে তাঁরা দুজন। ক্লেরমোতে তাঁরা থাকেন। লসির বিয়ের কথাবাতা ঠিক হয়েছে একজন ধনী ব্যবসায়ীর সঙ্গে। ধনী ব্যক্তিটির প্রথম স্ত্রী মারা গেছেন এবং ছেলেমেয়েও নেই। নাম লেচেনডেল। সে ছটিতে কাকার কাছে যাচ্ছে এবং সেখানে লেচেনডেলের সঙ্গে তার পরিচয় হবে। অবশ্য এর আগে একটা ছবি লসি দেখেছে।

সরলমনে লুসি সব কিছু অকপটে বলে গেল, গােপন রাখলাে না কিছুই। আমার চোখে লােকটির একটু বয়েস হয়েছে আর চেহারাও তেমন নয়। কিন্তু না করে উপায় কি ? আর কতদিন দাসীগিরি করবাে। সন্ধহীন জীবন, একটু সঙ্গপরশ সুধরে স্পর্শ পাওয়ার জন্য মনটা কাঙাল হয়ে আছে। কোথাও মায়া, করুণা ভালােবাসা নেই। তাই ঠিক করেহিষটাকে দেখে যদি খারাপ না লাগে তাহলে বিয়ে করবাে।

অসীম দুঃখের সঙ্গে কথাগুলি জানালাে লুসি কথাগুলি একটানা বলে যখন শেষ করলাে তখন একটা লম্বা শ্বাস বেরিয়ে এল তার বুক থেকে। তার পরিপক্ক ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁতগুলি দেখা গেল।

প্রাণভরে শিল্পী দেখছে নিখত গড়নে তৈরী অপ্ররুপ মুখখানি। তার নীল দুটি চোখে যেন জলছে আগুন। প্রেম-বভুক্ষ, তরুণীর আকুল অন্তরের সুগভীর কামনায় চঞ্চল। তার চোখের কি মায়ামদীর ভঙ্গী। একটি চুমার জন্য ক্ষধিত দুটি রাঙা ঠোঁট। নিঃসঙ্গ জীবন তাকে যন্ত্রনায় মুড়ে দিয়েছে। যৌবনজালায় তার সারা অঙ্গে আগুন লেগেছে। কিন্তু ঐ তুষানল থেকে রেহাই নেই।

এসপ্রিট কামনায় অধীর হয়ে উঠেছে। এই মুহুর্তে যদি সে ঐ রমণীকে নিজের দৃঢ় বাহু বন্ধনে বাঁধতে পারতাে, চুমায় চুমায় তাকে ভরিয়ে দিতে
পারতাে। তার মনে হল, যে অপরিচিত বর্বর, মধ্যবয়সী যে প্রৌঢ় এই তরুণীর যৌবনস্বাদ লুঠ করতে চলেছে, না না, তার হাত থেকে লুসিকে ছিনিয়ে নিতে হবে।

একসময় বলে ওঠে এসপিট—বলেন কি, আপনার মত এমন রুপ যৌবনের অধিকারিণী রমণী অবশেষে একজন বুড়াে টাকাওয়ালা ব্যবসায়ীর কাছে আত্মনিবেন করবেন। ছিঃ ছিঃ, একাজ কখনােই করবেন না, এ একেবারে আত্মহত্যার সমতুল্য। আপনাকে আমি যা বলছি শুনুন।

এই অনুনয়কে আরাে কঠিন করার জন্য উত্তেজনায় শিল্পী এসটি লুসির দুটি হাত চেপে ধরল। লসি প্রথমে আপত্তি করেনি। কিন্তু কি বিপদ, কিছুতেই হাত ছাড়ছে না। ভয়ে ও বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়ল সে। কিন্তু নিজের আঙুলগুলিকে ঐ শক্ত বাঁধনের হাত থেকে কিছুতেই মুক্ত করতে পারে না।

এখন ট্রেনটা খাড়াই-এর ওপর দিয়ে চলেছে। একটু পরেই আবার সমতল ভূমি দিয়ে যাবে। চারিদিকে ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন। খানিক পরেই শােনা যাবে গােচারণের টুং-টাং ঘণ্টাধ্বনি, আর সােনাভরা আলাে দেখা যাবে। দুরন্ত বাতাসে ভেসে এল একগুচ্ছ চেরী ফুল-বয়ে নিয়ে এল বসন্তের নসর উত্তেজনা। একটি টানেলের মধ্যে ট্রেনটা ডুবে গেল।

ঘন অন্ধকারে দুজনে নিবিড় ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে আছে এসপ্রিট একটা চমৎকার সুযােগ পেয়ে গেছে হাতের মুঠোয়। নিজের অবস্থাটা আন্দাজ করে তরুণী লুসি একেবারে কুকড়ে যায়। নিজেকে আর রক্ষা করতে পারে না। এসপ্রিট আবেগে দুটি হাত দিয়ে ওর কোমরটা জড়িয়ে ধরে বুকের মধ্যে চেপে ধরে ।
গাড়িটা একসময় অন্ধকারের গহিন থেকে আলাের বন্যায় বেরিয়ে এল। লজ্জাবনত মুখে লুসি বলে—কেউ যদি দেখতে পায় ?
-কে আর দেখবে? আকাশের গায়ে ঐ যে পাখির দল উড়ছে, ওরা দেখবে ? এসব নিয়ে মাথা ব্যাথার কাজ নেই। আমি তোমাকে প্রাণ উজাড় করে ভালােবাসতে চাই। সেখানে কোন বাধা থাকতে পারে না আর থাকলেও আমি মানবাে না।

ট্রেনটা আবার একটা টানেলে প্রবেশ করে। লসি সারা দেহে চুম্বনের স্পর্শ পায়। উপলদ্ধি করে দারুণ উত্তেজনা।
একটা অসহ্য আনন্দে মন ভরে উঠেছে। লসির দেহের আবরণ ধীরে ধীরে খসে পড়ছে। যৌবনের ডালি তুলে ধরেছে শিল্পী এসপ্রিটের হাতে। তার প্রবল পেষনে সে নিষ্পেষিত। সারা দেহে কোথাও এতটুকু ফাঁক নেই, লুসির বাধা দেওয়ার ক্ষমতা নেই। একটা নির্মম দস্যুর মত এসপ্রিট লণ্ঠন করছে লসির দেহসম্ভার।

অলস বিবশ মাদকতায় লুসি অবশ হয়ে পড়েছে। কিছুতেই এসপ্রিটের কবল থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারছে না। কামনায় আবেগ স্তিমিত হয়ে লুসি চুপ করে পড়ে আছে। মাথাটা একপাশে গড়িয়ে পড়েছে। যেন স্বপ্ন দেখছে—মদির স্বপ্নের আবেশে সে তন্দ্রাচ্ছন্ন।
একসময় টানেল পার হল, আবার আলােয় চারিদিক ভেসে গেল। অবশেষে ট্রেনটা একটা ছােট্ট স্টেশনে থামলাে, শােনা গেল কলরব।
লসি সুগভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, এইতাে, ক্লেরমোঁতের এসে গেছে। এইবার আমাকে ছেড়ে দিন। আপনাকে অনুনয় করছি, এটা স্টেশন, এখন আমাকে ছাড়ুন।

নিজেকে কোনরকমে মুক্ত করে উঠে দাঁড়ায়। নিজের পােষাক ঠিক করে নিয়ে, খােলা চুলগুলিকে খোঁপা করে বেধে নেয়।
ট্রেন ছাড়া মাত্রই এসপ্রিট আবার জড়িয়ে ধরলাে লুসিকে, বলল—ক্লেরমোতে গিয়ে কি হবে ?
নাগপাশের মত ঘিরেছে লসিকে এসপিটের বধ্য কামনায় উন্মাদ হয়ে ওঠে এসপ্রিট –তোমাকে আমি কিছুতেই ছাড়বাে , আমার কাছে রেখে দেব তােমাকে, কিছুতেই ছাড়বাে না।
একটু ঠাণ্ডা হয়ে বসুন। যে নিজেকে মুক্ত করার জন্য চেষ্টা করে। অরণ্যভূমির মধ্য দিয়ে প্রবল গতিতে ট্রেন ছুটে চলেছে। অনেক কষ্টের পর নিজেকে একটু বাঁধন মুক্ত করে লসি।

সুন্দর একটি রৌদ্রস্নাত গ্রাম। ক্ৰমে একটি স্টেশনের বহিরেখা দেখা গেল। তারপর স্টেশন।
চেচিয়ে ওঠে লসি—ঐ তাে খুড়িমা আর খুড়াে দাঁড়িয়ে আছেন, সঙ্গে ঐ লােকটি কে? নিশ্চয়ই লেচেনডেল। | এসটি উঠে দাঁড়ায়। সটান গিয়ে দরজাটা আড়াল করে দাঁড়ায়, বলেঐভাবে ঐ বড়াে ভদ্রলােকের দাঁড়ানােটা উচিত হয়নি। কি নির্লজ্জ।
পরমহতেই জানলাটা বন্ধ করে দেয় এসপ্রিট । একটা দৃঢ়তার ছাপ তার চোখে মুখে। ক্ষেপে গেছে যেন।
এসপ্রিট জ্ঞান শূন্য হয়ে বলে-না না, ঐ বুড়ােটার হাতে তােমাকে কিছুতেই তুলে দেব না। তােমাকে আমি প্রাণ দিয়ে ভালােবাসি লুসি। আমরা দুজনে সঙ্গহারা হলে চলবে না।
স্টেশন এসে গেছে। ধীরে ধীরে ট্রেনটা থেমে গেল।
লুসি মনে করেছে, শিল্পী হয়তাে রহস্য করছে। তাই ব্যাগ, ছাতা গুছিয়ে নিয়ে নামবার উপক্রম করলাে। | সত্যি বলছি, ছেড়ে দিন। ছাড়ুন আমাকে, এটা রসিকতার সময় নয়। লুসির কণ্ঠে মিনতি ঝরে পড়ে।

এসপ্রিট কিন্তু কোন কথায় কান দেয় না। লুসিকে জড়িয়ে ধরে চুমায় চুমায় ভরিয়ে দেয় তার মুখে। কোন কথা বলতে দেয় না।
বাইরে থেকে খুড়ােখুড়িনার কণ্ঠস্বর ভেসে এল, লুসি। কিন্তু সবই বথা।

জানলার দিকে পিঠ করে এসপ্রিট লসিকে আড়াল করে রেখেছে—আর তার ঠোঁট দুটি নিজের ঠোঁটের মধ্যে রেখেছে। সলজ্জকণ্ঠে লসি বলে-দোহাই আপনার, আমাকে ছেড়ে দিন, ওরা আমাকে ডাকছে।
নিষ্ফল আবেদন। এসপ্রিট যেন কাণ্ডজ্ঞানহারা। একসময়ে বাঁশী বাজল, ট্রেন চলতে শুরু করে। ছােট্ট স্টেশন ধীরে ধীরে অদৃশ্য হল।
নিস্ফল সংগ্রামে পরাজিত লুসি হঁতাশায় আবার নিজের জায়গায় বসে পড়ে।

আবার এসপ্রিট তাকে জড়িয়ে ধরার জন্য এগিয়ে এল। এইবার লসির বাধা প্রবলতর, সে ওকে ঠেলে ফেলে দিল।
তারপর একপাশে গুটিসুটি মেরে বসে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।
কান্না ভেজা কন্ঠে বলে—সত্যি আপনি ভীষণ নির্দয়। একি করলেন বলুন তাে? আপনাকে চোখে দেখাও পাপ।
লসিকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে এসপ্রিট । কিন্তু কানও দেয় না তার কথায়। ভীষণ রেগে গেছে সে, মুখ ভার করে স্থানর মত বসে আছে। মুখে নেই কথা, নেই সেই প্রসন্ন হাসি।

ভিজিল স্টেশনে গাড়ী এসে থামল। হড়মড় করে যাত্রীরা দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলাে। মুহুর্তের মধ্যে ভর্তি হয়ে গেল কামরাটি। গ্লেননাচলে বেড়াতে যাচ্ছে সবাই। বিষন্ন মুখে এসপ্রিট চুপ করে বসে আছে।
লুসি তার বসবার জায়গা থেকে মুখ ফিরিয়ে দরজার দিকে মুখ করে বসে রইল।

এসপ্রিট আকাশ-পাতাল ভাবছে। লুসিরও ভাবনার শেষ নেই। মেজাজটাও অনেকটা হালকা হয়েছে। এইভাবে চলে আসার পরিণতি কি দাঁড়াবে তাই ভাবে। তাছাড়া এই ব্যাপারটিতে তারও একটা ভূমিকা আছে। সে এসপ্রিটকে তেমন বাধা দেয়নি।

গ্রেনােবল স্টেশনে গাড়ী এসে থামল। নীরবে এসপ্রিট লুসির হাত ধরে নামিয়ে নেয়, নিজে হাতে তুলে নেয় তার মালপত্র । এসপ্রিটকে দেখে তার মায়া হচ্ছে। মুখে ফুটে উঠেছে বিভ্রান্ত ভঙ্গি। এসপ্রিটকে অনুসরণ করে পােষা প্রাণীর মত চলেছে লুসি। একটা হােটেলে শিল্পী ওকে নিয়ে উঠল।

একটা ঘরে হােটেলের কর্মচারী ওদের দুজনকে দিয়ে চলে গেল আবার দুজনে একা, ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে এল পরস্পরে।
লুসি দুঃখে হতাশায় ডুকরে কেদে উঠল। আর কান্নার বেগে বুকটা কেপে উঠছে।

এইবার শিল্পী একটু ভয় পেয়েছে। মেয়েটা যে এমন করবে তা সে আন্দাজ করতে পারেনি। সে তাকে ভােলানাের জন্য তার পায়ের কাছে বসে কয়েকটা ভাল মিষ্টি কথা শােনালাে। কিন্তু ব্যর্থ প্রচেষ্টা। লুসির কান্না ক্ৰমশঃ বাড়তে থাকে। দুহাত দিয়ে ঠেলে দিয়ে বলে আপনি এখান থেকে চলে যান।
আপনি যদি মানুষ হন তাহলে আমার কাছে আর আসবেন না। আমি আমার উপযুক্ত শাস্তি পেয়েছি। আমার খুড়ােরা হাকিমের বাড়িতে চিঠি দেবে, ওরা কি মনে করবে। আমার চাকরি যাবে, আমি বেকার হব, লাঞ্ছিত অপমানিত হব। এসবের মুলে আপনি। আপনি আমাকে খারাপ মেয়ে মনে করে এই বিশ্রী ব্যাপারটা ঘটালেন। আমি আপনাকে বাধা দিতে পারিনি, তাই আমার কলঙ্ক।
আবার সে গুমরে কেদে ওঠে। কিছুতেই এসটি তাকে থামাতে পারে না।

বিচলিত হয়ে পড়েছে এসপ্রিট । মেয়েটি ভালাে ও ঠিকই বলেছে, আমার ব্যবহারটাই ভাল হয় নি, একটা লম্পটের মত কাজ করেছি। এসপ্রিট লােকটা কিন্তু সৎ। অবশ্য সংযমের অভাব তার চরিত্রে, যা অনেক যুবকেরই থাকে না। তবে মেয়েটির এই অনিচ্ছার ওপর জোর খাটানােও উচিত নয়। এ যেন একটা অসহায়ত্বে সুযােগ নেওয়া।
সত্যি এসপ্রিটের এ কাজটা শােভনীয় হয় নি। এমন পরমা সুন্দরী বসে বসে কাঁদছে। এমন সরল সহজ মেয়েকে নিয়ে এইভাবে নাজেহাল করা বে-আক্কেলী কাজ হয়েছে।

অনুতাপ জাগলাে এসপ্রিটের মনে। সে এগিয়ে গেল মেয়েটির কাছে। ধীরে ধীরে বললাে—এতটা আকুল হয়াে না, আমাকে ক্ষমা করাে। আমি তােমাদের সেশনে তােমাকে পৌঁছে দেব। ট্রেনে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, গ্রেনােবলে চলে গিয়েছিলাম আবার ফিরতি ট্রেনে চলে এসেছি, এই কথা বলবে তােমার খুড়াে-খড়িমাকে। তাহলে কোন ঝামেলার সম্মুখীন হতে হবে না।

“নিন চোখে মুখে জল দিয়ে দিন। আমি একেবারে জ্ঞানশুন্যের মত কাজ করেছি। আমি কিন্তু আসলে ছােটলােক নই—তোমাকে আমি প্রাণভরে ভালােবাসি, লুসি—
লুসি একটাও কথা বলে নি আর।
আবার এসপ্রিট তাকে স্টেশনে নিয়ে এল। এক ট্রেন ছাড়ছিল। চটপট একটা টিকিট কেটে মেয়েটির হাতে দিয়ে দিল এবং গাড়ীতে তুলে দেয়। সঙ্গে কিছু খাবার ও চকোলেট দিয়ে দেয়।

লুসি যেন এতক্ষণে অন্ধকার থেকে আলাের মুখ দেখতে পেল। আর কোন ভয় নেই, এখন থেকে সে মুক্ত ; ঠোঁটের ফাঁকে হাসির রেখা, ধন্যবাদ জানালাে এসপ্রিটকে । বেচারী এসপ্রিট ম্লান মুখে গাড়ি থেকে নেমে এল।
একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে ট্রেন ছাড়ল।
সেই ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে শিল্পী মনে মনে ভাবে—আহা, কি অপরূপ সুন্দরী, এই রুপসী নাকি হারামজাদা লেচেনডেলের শয্যাসঙ্গিনী হবে। এমন পরমা সুন্দরী লসি আর বুড়াে লেচেনডেল ভাগ্যের কি অদ্ভুত পরিহাস।

The post ভালােবাসা ভালােবাসা – প্রফুল্ল কুমার পাত্র appeared first on লেখালেখি.


Tags: , , , , , ,

Comments are closed here.