লিঙ্গপুরাণঃ আদি ও অকৃত্রিম মহানায়কের উত্থান-পতন

December 24, 2020 | By Admin | Filed in: বিখ্যাত লেখকদের সাহিত্যে যৌনতা.

অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়

Linga-Puran-Cover-Final-218x300………“ক্রুদ্ধ মহর্ষিদের অভিশাপে শিবের লিঙ্গ খসে পড়ে এবং তা ক্রমাগত বাড়তে থাকে। ব্রহ্মা, বিষ্ণু প্রমুখ এসে শিবকে তার লিঙ্গ গ্রহণ করতে অনুরােধ করেন। এ লিঙ্গের পুজো করতে হবে – এই শর্তে রাজি হলেই শিব তা আবার ধারণ করেন।” লিঙ্গ (সংস্কৃতে লিঙ্গ + অ, অথবা শিশ্ন = শ + ন) বলতে প্রথমেই যে ছবিটা মানুষের মনে ভেসে ওঠে সেটা হল পুরুষের যৌনাঙ্গ, ইংরেজিতে যেটি PENIS বােঝায়। অপরদিকে লিঙ্গ বলতে GENDER-ও বােঝায়। মানুষ যে শব্দের উপর ব্যক্তিত্ব আরােপ করতে চেয়েছে তার প্রমাণ ভাষায় এই ‘লিঙ্গ’-কল্পনা। পুরুষবাচক শব্দ (কিশাের, পুত্র, দেব ইত্যাদি) পুংলিঙ্গ বলে চিহ্নিত হল। আর স্ত্রীবাচক শব্দ (কিশােরী, পুত্রী, দেবী ইত্যাদি) চিহ্নিত হল স্ত্রীলিঙ্গ হিসাবে। ‘চিহ্নিত’ শব্দটি ব্যবহার করার কারণ ‘লিঙ্গ’ আর ‘চিহ্ন’ সমার্থক। কিন্তু যেসব জিনিস অচেতন, তারা সব যদি ক্লীবলিঙ্গ বলে চিহ্নিত হত, তাহলে তাে কথাই ছিল । কিন্তু এই অচেতন জিনিসগুলাের কিছু চিহ্নিত হল পুংলিঙ্গ হিসাবে, কিছু চিহ্নিত হল স্ত্রীলিঙ্গ হিসাবে।……..

…….লিঙ্গ-নির্ধারণ বােঝাতে শিশ্ন (পুরুষ) অথবা যােনি (মহিলা) দুই-ই বােঝালেও লিঙ্গ আসলে পুরুষের যৌনাঙ্গকেই বােঝায়। পুরুষের যৌনতার জন্য প্রধান অঙ্গ হল তার লিঙ্গ। এটি পুরুষের প্রধান যৌনাঙ্গ। এই লিঙ্গের দ্বারা পুরুষ যৌনমিলনে অংশ নেয় এবং মানসিক ও শারীরিক প্রশান্তি লাভ করে। লিঙ্গের দৃঢ়তার উপর নির্ভর করে পুরুষের যৌনমিলনে অংশগ্রহণের ব্যাপারটি। এই লিঙ্গের একই ছিদ্র দিয়ে বীর্য এবং মুত্র নির্গত হয়।

লিঙ্গের বেশ কিছু সমার্থক শব্দও আছে, যা পুরুষের যৌনাঙ্গই বােঝায়। যেমন – শিশ্ন, পুং, উপস্থ, ধােন, বাড়া, বংশদণ্ড ইত্যাদি।………

লিঙ্গের স্বাভাবিক আকার কত?

লিঙ্গের আকার নিয়ে পুরুষজাতির হীনমন্যতার শেষ নেই! কেন এই হীনমন্যতা? প্রথম কারণ অজ্ঞানতা বা যৌনশিক্ষায় উদাসীনতা, দ্বিতীয় কারণ ভুল শিক্ষা, তৃতীয় কারণ নীলছবির বর্ধিত লিঙ্গদর্শন (অনের পুরুষ কিংবা নারী পর্নোফিল্ম দেখে লিঙ্গের আকার এবং মিলনের সময় নিয়ে নিজের মধ্যে একপ্রকার নেগেটিভ ধারণা করে রাখে। সত্যিকার অর্থে ছবিতে নায়ক তারাই হয় যারা অন্যদের তুলনায় হ্যান্ডসাম হয়। পর্নোস্টারও তার ব্যকিক্রম নয়। পর্নোগ্রাফিতে ক্যামেরা এমন অ্যাঙ্গেলে ধরা হয়। যাতে ভিজুয়ালি লিঙ্গকে বড়াে দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ আপনি যদি কোনাে একটি উঁচু স্থান থেকে নীচে দাঁড়ানাে আপনার কোনাে বন্ধু ছবি তােলেন তাহলে তাকে খাটো দেখাবে। তেমনই যদি আপনি মাটিতে বসে কিছুটা উপরে দাঁড়ানাে অবস্থায় আপনার বন্ধুর ছবি তােলেন তাহলে একই ব্যক্তিকে অনেক লম্বা দেখাবে। আর সে জন্যই আমরা যখন মাথা নীচু করে আমাদের নিজের লিঙ্গ দেখতে যাই তখন ভিজুয়াল ইলশানের কারণে আমাদের লিঙ্গের আকার প্রকৃত আকারের চেয়ে ছােটো দেখা যায়। তা ছাড়া এখানে আরও একটি বিষয়টি বলে রাখতে চাই, তা হল – পর্নোফিল্মে দেখা যায় একই যুগল ২০/২৫ মিনিট মিলন করছে। সত্যিকার অর্থে তাদের এই ২০ মিনিটের মিলন দৃশ্যের শুটিং হয়েছে ২/৩ দিন ধরে। তাদের অনেকবারের মিলনের দৃষ্টিনন্দন অংশগুলাে ভিডিও এডিটে কাট-ছাঁট করে একটি ক্লিপ বাজারে আসে। তাই পর্নোফিল্ম দেখে লিঙ্গের আকার এবং মিলনের সময় নিয়ে আমাদের হা-হতাশের অবকাশ নেই। কারণ সমীক্ষায় দেখা গেছে, ওইসব দেশের বেশির ভাগ পুরুষরই ২-৩ মিনিটের বেশি যৌনমিলন করতে পারে না। এটাই স্বাভাবিক ও বাস্তব চিত্র।) চতুর্থ কারণ ভুইফোড় হাতুড়ে ডাক্তার (আপনি লিঙ্গ বড়াে করা সংক্রান্ত যত প্রকার বিজ্ঞাপন দেখে থাকবেন এইগুলির অধিকাংশেরই কোনােরকম বৈধতা নেই – এককথায় এসব ভুয়াে চিকিৎসক এবং ভুয়াে চিকিৎসা-বাণিজ্য। লক্ষ করে দেখবেন তাদের বিজ্ঞাপনগুলােতে কোমলমতি তরুণদের আকৃষ্ট করার জন্য নানা প্রকার অশ্লীল ছবি জুড়ে দেয়। তাদের কোনাে ঠিকানা দেওয়া থাকে না, আর থাকলেও সেটা নকল। তারা শুধুমাত্র ফোন নম্বর দিয়ে রাখে। এসব দেখেও যদি আপনার চোখ না খােলে আর লােভে পড়ে ফাদে পা বাড়ান তাহলে আপনার ক্ষতির জন্য আপনিই দায়ী।) এবং পঞ্চম কারণ অবশ্যই রক্ষণশীলতা। প্রায় অর্ধেক প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ মনে করেন তার পুরুষাঙ্গটি ছােটো। বিশ্বজুড়ে সাধারণত উত্তেজিত অবস্থায় পুরুষ লিঙ্গের গড় দৈর্ঘ্য হয়ে থাকে ৪.৭ থেকে ৬.৩ ইঞ্চি। অনেকের মতে লিঙ্গের গড় দৈর্ঘ্য ৫.১ থেকে ৫.৯ ইঞ্চি। তবে লিঙ্গের আকার ব্যক্তি, প্রজাতি, গােষ্ঠী এবং অঞ্চলভেদে কিছুটা পার্থক্য দেখা যায়। বিরল ক্ষেত্রে পারিবারিক (জেনেটিক) এবং হরমােনজনিত সমস্যার কারণে ৩ ইঞ্চির চেয়েও অনেক ছােটো লিঙ্গ দেখা যায়। চিকিৎসাশাস্ত্রে এটি মাইক্রোপেনিস নামে পরিচিত। তবে পেনিস ৪ (চার) ইঞ্চি হলেই স্ত্রীকে অর্গাজম দিতে কোনােপ্রকার অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। অনেকের ক্ষেত্রে প্রােস্টেট ক্যান্সার অপারেশন সহ নানা রােগের কারণে লিঙ্গের আকার ছােটো হয়ে যেতে পারে। যৌন তৃপ্তির জন্য লিঙ্গের আকার মুল বিষয় নয়। প্রধান বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে মিলনে এবং শৃঙ্গারে আপনার কারুময়তা, নান্দনিকতা। আপনি যত বেশি সৃষ্টিশীল পদ্ধতিতে স্ত্রীকে ‘On’ করবেন সে তত বেশি আপনার পার্সোনালিটির প্রতি আবেগপ্রবণ হবে।

যৌনজীবনে লিঙ্গ-বিষয়ক কিছু জরুরি তথ্য ঃ

(১) উত্তেজিত অবস্থায় পুরুষ লিঙ্গের গড় দৈর্ঘ্য হয়ে থাকে ৪.৭ থেকে ৬.৩ ইঞ্চি। অনেকের মতে লিঙ্গের গড় দৈর্ঘ্য ৫.১ থেকে ৫৯ ইঞ্চি। (২) তবে আপনার লিঙ্গ যদি লম্বার সর্বনিম্ন ৪ (চার) ইঞ্চিও হয়ে থাকে তাহলেও আপনার স্ত্রীকে তৃপ্তি দিতে আপনার কোনাে সমস্যা হবে না। অনেকে আবার এও বলে থাকেন স্ত্রীকে অর্গাজম দিতে মাত্র ৩ ইঞ্চি লম্বা লিঙ্গ হলেই যথেষ্ট। (৩) বড়াে লিঙ্গ মানেই বেশি মজা, এই কথাটা ডাহা ভুল। আপনার ডিউরেশন কত এবং শেষ পর্যন্ত যৌনসঙ্গীটিতে মননশীলতার সঙ্গে যৌনতৃপ্তি দিতে পারলেন কি না সেটাই আসল। স্বাভাবিক সময় বা ডিওরেশান ৭ থেকে ১০ মিনিট। (৪) লিঙ্গ কখনােই একেবারে সােজা হয় না। সামান্য বাঁকা থাকেই, সেটা স্বাভাবিক বক্রতা। (৫) লিঙ্গের গোঁড়া সরু অগ্রভাগ মােটা এটা কোনাে সমস্যা নয়। অপপ্রচারের ফলে সবারই এটা একটা ভুল ধারণা হয়ে গেছে। (৬) কোনাে জাদুকরী তেল বা মালিশ লিঙ্গকে তেমন বড়াে করতে সক্ষম নয়। (৭) বেশি বড়াে লিঙ্গ হলে মেয়েরা মজা পাওয়ার বদলে ব্যথা অনুভব করেন। এমনকি সেটা যৌনাতঙ্কেরও রূপ নিতে পারে। (৮) ক্ষুদ্র লিঙ্গ বলতে ২.৭৬ ইঞ্চির চেয়ে ছােটো লিঙ্গ বােঝায়। সেক্ষেত্রে অবশ্যই ডাক্তার দেখাতে হবে। (৯) গোঁড়া সরু আগা মােটা বা বাঁকা লিঙ্গ যৌনমিলনে কোনাে সমস্যার সৃষ্টি করে না। (১০) লিঙ্গটাকে নিয়ন্ত্রণ করুন। একমাত্র স্ত্রী ছাড়া আর কোথাও ব্যবহার করবেন না। (১১) স্ত্রী ছাড়াই যৌন-উত্তেজনা হয় এমন কোনাে কাজ যেমন রসাতলে যাওয়া নারীর দিকে তাকানাে, অশ্লীল সাহিত্য পড়া, কম্পিউটার বা মােবাইলে খারাপ কিছু দেখা থেকে বিরত থাকুন।(১২) নিয়মিত Pubic Hair কাটুন।(১৩) আপনার যৌনস্বাস্থ্যের দিকে নজর দিন। এটাও আপনার শরীরেরই অংশ। (১৪) যৌন সমস্যার ব্যাপারে ভুল করেও কখনও অবহেলা করবেন না। যে-কোনাে যৌন সমস্যায় কোনাে প্রকার সংকোচ না-করে তাৎক্ষণিকভাবে আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।………..

অপরদিকে যােনি হল নারীর যৌনাঙ্গকে বলে। স্ত্রীযােনি গঠন ঃ স্তন্যপায়ী প্রাণীর প্রাইমেট বর্গের প্রাণীকুলের, স্ত্রীপ্রজনন তন্ত্রের একটি অন্যতম অঙ্গ। জরায়ুর নীচের দিকে ভালভা পর্যন্ত বিস্তৃত নালি। স্বাভাবিক অবস্থায় সামনের দিকে ৬ থেকে ৬.৫ সেন্টিমিটার এবং ভিতরে দিকে এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৮ থেকে ১০ সেন্টিমিটার। তবে যৌন উত্তেজনা, সন্তান প্রসবের সময় এর দৈর্ঘ্য-প্রস্থ প্রয়ােজন অনুসারে বৃদ্ধি পায়। অসম্ভব একটি নমনীয় গুণের কারণে যৌনমিলনের সময় এবং সন্তান প্রসবের সময় প্রচুর পরিমাণে সম্প্রসারিত হতে পারে। দাঁড়ানাে অবস্থায় যােনির শেষপ্রান্ত সামনে-পেছনে জরায়ুর সঙ্গে ৪৫ ডিগ্রির বেশি কোণ উৎপন্ন করে। যােনির ব্যাপ্তির বিচারে একে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। এই ভাগ দুটি হল –

(১) অন্তঃস্থিত যােনিঃ এই অংশ বাইরে থেকে দেখা যায় না। এমনকি সজোরে প্রসারিত করলেও বাইরে থেকে এই রঙ্কুটি স্পষ্ট হয় না বলে। এর নমনীয় মাংশপেশি গায়ে গায়ে লেগে থাকে বাইরে থেকে অবরুদ্ধ পথ বলে মনে হয়। এর উপরে অংশ জরায়ু-মুখের সঙ্গে যুক্ত থাকে। অবস্থানের বিচারে যােনি মূত্রনালির পিছনে এবং মলদ্বারে সামনে অবস্থিত। যােনির উপরের এক-চতুর্থাংশ রেকটোউটেরিন পাউচ দ্বারা মলাধার থেকে পৃথক থাকে। যােনিদ্বারের ভিতরের অংশের রং হালকা গােলাপি। এর ভিতরের পুরােটাই মিউকাস ঝিল্লি দ্বারা গঠিত। যােনির অভ্যন্তরের তিন-চতুর্থাংশ অঞ্চল উঁচুনীচু ভঁজে পরিপূর্ণ, এই ভজকে রুগি (rugae) বলে। যােনির পিচ্ছিলতা বার্থোলিনের গ্রন্থি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এই গ্রন্থি যােনির প্রবেশ মুখে এবং জরায়ু-মুখের কাছে অবস্থিত। যৌনমিলনের সময় প্রয়ােজনীয় পিচ্ছিলকারক তরল ক্ষরিত করার মাধ্যমে এটি লিঙ্গপ্রবেশ জনিত ঘর্ষণ হ্রাসে ভূমিকা রাখে এবং একই যৌন উত্তেজনা বৃদ্ধিতেও সহায়তা করে। প্রতি মাসে ডিম্বক্ষরণের সময় জরায়ু-মুখের মিউকাস গ্রন্থিগুলাে বিভিন্ন রকম মিউকাস ক্ষরণ করে। এর ফলে যােনির নালিতে ক্ষারধর্মী অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয় এবং এটি যৌনমিলনের মাধ্যমে প্রবিষ্ট পুরুষের শুক্রাণুর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। যােনিমুখ জন্মগতভাবে যােজক কলার একটি পাতলা পর্দা দিয়ে ঢাকা থাকে। এই পর্দাকে বলা হয় যােনিচ্ছদ বা সতীচ্ছদ। একসময় ধারণা ছিল পুরুষের সঙ্গে সঙ্গম ছাড়া বা কোনাে অপদ্রব্য। প্রবেশ ছাড়া এই পর্দা ছেড়ে না। এই পর্দা অক্ষুন্ন থাকাটা সতীনারীর প্রমাণ হিসাবে বিবেচনা করা হত (আজও কোনাে কোনাে দেশে সতীচ্ছদ পরীক্ষা করার পর অক্ষত হলে অক্ষতযােনির সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে নানা কারণে এই পর্দা ছিন্ন হতে পারে। ঘােড়ায় চড়া, সাইকেল চালনা, ব্যায়াম চর্চা, দৌড়ঝাপ ইত্যাদির কারণে এই পর্দা ছিড়ে যেতে পারে।

(২) বহিঃস্থ যােনিঃ যােনিদ্বার থেকে শুরু হয়ে যােনিনালির বাইরে বিস্তৃত অংশকে বহিঃস্থ যােনির ভিতরে ধরা হয়। এই অংশটিকে বলা হয় ভালভা (valva) বলে। ভালভা অনেকগুলাে ছােটো অংশ নিয়ে তৈরি। এই অংশগুলাে হল – যােনিমণ্ডপ ও মন্স পিউবিস বা যােনিমণ্ডপ নারীদেহের নিম্নাঙ্গের একটি নির্দিষ্ট এলাকা মানব অঙ্গসংস্থানবিদ্যায় এবং সাধারণ স্তন্যপায়ী প্রাণীতে পিউবিক অস্থি, পিউবিক সিমফাইসিস সংযােগের উপর মেদ কলা জমে থাকা উঁচু ঢিপির (mound) মতাে অংশটিকে “মন্স পিউবিস” বা “যােনিমণ্ডপ” বলে। এটি লাতিন শব্দ ‘pubic mound’ থেকে এসেছে, এছাড়া এটি মন্স ভেনেরিস (mound of venus) নামেও পরিচিত। মন্স পিউবিস ভালভার উপরের অংশ গঠন করে। মন্স পিউবিসে আকার সাধারণত শরীরে হরমােন ক্ষরণ ও মেদের পরিমাণের উপর নির্ভর করে। বয়ঃসন্ধির পর এটি প্রসারিত হয়, এর উপরভাগে অংশ চুলে ঢেকে যায়, যা যৌনকেশ নামে পরিচিত। নারীর দেহে এই উঁচু অংশটি মেদ কলা দিয়ে গঠিত এবং যথেষ্ট পরিমাণে বড়াে। যৌনমিলনের সময় এটি পিউবিক অস্থিকে রক্ষা করে। নারীর মন্স পিউবিস যে কয়েকটি অংশে বিভক্ত তার নিম্নভাগে আছে বৃহদ্দোষ্ঠ, এবং অন্য পাশে হলরেখার (লাঙ্গল ফলার দাগ) মতাে অংশ, যা যােনিচিরল নামে পরিচিত। ক্লেফট অফ ভেনাস যে সকল অংশ পরিবেষ্টন করে রেখেছে সেগুলাে হল – নিম্নোষ্ঠ, ভগ্নাঙ্কুর, যােনির প্রবেশদ্বার এবং ভালভাল ভেস্টিবিউলের অন্যান্য অংশ। মন্স ভেনেরিসের মেদ কলা ইস্ট্রোজেন ক্ষরণে প্রতিক্রিয়াশীল, যা বয়ঃসন্ধি শুরুর সময় একটি স্বতন্ত্র উঁচু অংশের সৃষ্টি করে। পরবর্তীতে এটি লেবিয়া মেজরার সামনের অংশে, পিউবিক অস্থি থেকে সরে যায়। যােনিওষ্ঠ (Labia) দুইটি মাংসল ভাঁজ যােনিপথকে আবৃত করে রাখে। এর বড়াে ভাজটিকে বলা হয় বৃহদ্দোষ্ঠ (Labia majora)। বৃহদ্দোষ্ঠের ভিতরের দিকে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র মাংসল ভাজকে বলা হয় ক্ষুদ্রোষ্ঠ (Labia minora)। বৃহদ্দোষ্ঠ বহিঃস্থ অংশ, রঙিন। এবং চুলবিশিষ্ট; এবং অন্যটি ভিতরের অংশ, যা কোমল ও সেবাসিয়াস ফলিকল সমৃদ্ধ। এটি বৃহদ্দোষ্ঠের ভিতরের দিকে থাকে।

ভগাঙ্কুর (Clitoris)ঃ যােনিওষ্ঠের উপরের দিকে ছােটো বােতামের মতাে একটি অংশ থাকে। একে বলা হয় ভগাঙ্কুর। এই অংশটি যােনিমুখ ও মূত্রনালির প্রবেশমুখের উপরাংশে অবস্থিত। এটি যৌন মিলনকালে তৃপ্তি প্রদান করে। যেহেতু এটি একটি অভ্যন্তরীণ অঙ্গ তাই এর বর্ণ চামড়া মতাে না-হয়ে ঝিল্লির মতাে হয়। এটির উচ্চতা সিকি ইঞ্চি থেকে ১ ইঞ্চি পর্যন্ত হয়। তবে যৌন উত্তেজনা বাড়তে থাকলে এটি শক্ত ও দীর্ঘ হতে থাকে।

যােনিচ্ছদ বা সতীচ্ছদ (Hymen) ঃ এটি মিউকাস মেমব্রেন দ্বারা সৃষ্ট একটি পর্দা। এই পর্দা যা যােনির প্রবেশমুখ আংশিক বা সম্পূর্ণ আবরিত করে রাখে। এটি লেবিয়া মাইনরার মধ্যবর্তীস্থানে অবস্থিত ভালভার একটি অংশ, যেখানে ইউরেথ্রাল ও যােনির প্রবেশমুখ উন্মুক্ত। এর প্রান্ত হার্টের লাইন দ্বারা চিহ্নিত। যােনির সম্মুখে, গ্ল্যান্স ক্লিটোরিসের ২.৫ সেন্টিমিটার ভিতরে বহিঃস্থ ইউরেথ্রাল অরফিস অবস্থিত। সাধারণত এটিকে স্কিনির ডাক্টের প্রবেশমুখের নিকটে ছােটো, হালকা স্পষ্ট দাগ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। আর ভ্যাজাইনাল অফিস হচ্ছে মূত্রনালির নীচে ও পিছনে অবস্থিত একপ্রকার মধ্যম আকৃতিবিশিষ্ট চির; এর আকার সতীচ্ছদের আকৃতির সঙ্গে ব্যাস্তানুপাতিক হারে পরিবর্তিত হয়।

বার্থোলিনের গ্রন্থি (Bartholin’s glands) ঃ একে অনেক সময় বৃহৎ ভেসটিবিউলার গ্রন্থি (greater vestibular glands) বলা হয়। দুটি গ্রন্থি নারীর যােনির প্রবেশদ্বারের কাছে একটু নীচে ডানে ও বামে থাকে। খ্রিস্টীয় সপ্তদশ শতকে এই গ্রন্থি দুটি সম্পর্কে প্রথম ড্যানিশ শরীরবিদ ক্যাসপার বার্থোলিন দ্য ইয়াঙ্গার (১৬৫৫-১৭৩৮) এদের বর্ণনা দেন। এই বিজ্ঞানীর নামে এই গ্রন্থিদ্বয়ের নামকরণ করা হয়।

গ্রাফেনবার্গ স্পট বা জি-স্পট ঃ এটি হচ্ছে যােনিপথের একটি ক্ষুদ্র অংশবিশেষ। এই অংশটি মূত্রথলির নীচে অবস্থিত। এর নামকরণ করা হয়েছে জার্মান স্ত্রীরােগ বিশেষজ্ঞ আর্নেস্ট গ্রাফেনবার্গের নামানুসারে। যােনিপথের শুরু হতে ১-৩ ইঞ্চির মাঝেই এর অবস্থান। সঙ্গমকালে যােনিমুখের ১-৩ ইঞ্চির ভিতরে নারী সবচেয়ে বেশি পুলক অনুভব করে। এই অধিক সংবেদনশীল অংশকেই জি-স্পট বলা হয়।

রক্তমাংসের লিঙ্গের তাে অনেকটা আলােচনা করা গেল, কিন্তু কৃত্রিম লিঙ্গের আলােচনা না করলে এ প্রবন্ধ অম্পূর্ণ থেকে যাবে। কৃত্রিম লিঙ্গ বা ডিলডাে পুংজননেন্দ্রিয় সদৃশ এক ধরনের যৌনখেলনা। বিশেষ করে হস্তমৈথুনের বা এধরনের বিকল্প রতিক্রিড়ার সময় অথবা সঙ্গীর সঙ্গে যৌনকর্মে লিপ্ত হওয়ার সময় শারীরিক অনুপ্রবেশের উদ্দেশ্যে কৃত্রিম লিঙ্গ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কৃত্রিম লিঙ্গ আকৃতি-আকার এবং সামগ্রিক চেহারার দিক দিয়ে দেখতে উলম্ব বা উখিত পুরুষ-শিশ্নের মতাে। এর প্রসারিত বর্ণনা সংযুক্ত রয়েছে ভাইব্রেটর সামগ্রীতে। এই ধরনের লিঙ্গাকৃতির সরঞ্জাম যােনিপথে অনুপ্রবেশের জন্যে ব্যবহৃত হয়, যা মানসিকভাবে পুরুষ-লিঙ্গের মতাে ব্যবহার করা যায়। যে সমস্ত পুরুষ ও মহিলারা অ্যানাল সেক্স পছন্দ করেন তারা অনেকে পায়ুপথে অনুপ্রবেশের জন্যেও এটা ব্যবহার করে থাকে। কৃত্রিম লিঙ্গ সব লিঙ্গের মানুষের দ্বারা ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এটা মূলত হস্তমৈথুন এবং অন্যান্য যৌন কার্যকলাপের নিরাপদ বিকল্প উপায়মাত্র। কৃত্রিম লিঙ্গের বস্তুকাম মূল্য আছে। তবে কিছু ব্যবহারকারী অন্য উপায়েও এটি ব্যবহার করে থাকেন। উদাহরণস্বরূপ পূর্বরাগের সময় চামড়ার উপর চালনা করা। উপযুক্ত আকারের হলে, কৃত্রিম মুখমেহনের জন্য মৌখিক অনুপ্রবেশ কাজেও এর ব্যবহার হয়ে থাকে। কোনাে-কোনাে ব্যক্তি কৃত্রিম লিঙ্গ বিশেষভাবে জি-স্পট উদ্দীপিত করার কাজে ব্যবহার করে। কৃত্রিম লিঙ্গ বস্তুত ফাঁপা ধরনের। পুরুষ তার লিঙ্গ এই কৃত্রিম লিঙ্গের ভিতর পুরে নিয়ে নারীর সঙ্গে সঙ্গমে রত হতে পারে। যে সকল পুরুষের লিঙ্গোত্থান সমস্যা আছে তারা এই খেলনা ব্যবহার করে থাকে। এই ডিলডাে নামক যন্ত্রটি কোমরে শক্ত করে বাঁধার জন্য চামড়ার স্ট্যাপ থাকে যার কারণে এর নাম স্ট্র্যাপ অন ডিলডাে। অন্যদিকে নারী সমকামীরা যােনিভেদের আনন্দ লাভের উদ্দেশ্যে “ট্র্যাপ-অন ডিলডাে” ধারণ করে একজন আরেকজনকে তৃপ্ত করতে পারে। পায়ুপথে ঢােকানাে এবং নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কৃত্রিম শিশ্নের অবস্থান করাকে বাট প্লাগ বলা হয়। কৃত্রিম শিশ্ন পায়ুপথে অনুপ্রবেশের পুনরাবৃত্তি অথবা দ্রুতলয়ে খোঁচানাের জন্য ব্যবহৃত।……

…….কৃত্রিম লিঙ্গ গ্রিক দানিশিল্পে দেখা যায়। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে, এধরনের দানিশিল্পে একটি দৃশ্য রচিত আছে যেখানে মৌখিক যৌনকর্মে লিপ্ত একজন মহিলা একজন পুরুষের উপর ঝুঁকে আছে এবং অন্য একজন পুরুষ তার পায়ুপথে কৃত্রিম লিঙ্গ প্রবেশের চেষ্টা করছে।…….

…….সব থেকে আকর্ষণীয় বিষয় হচ্ছে লিঙ্গ রেলি। মন্দিরের কাঠের লিঙ্গটি নিয়ে রেলিতে বের হন ভক্তরা। সঙ্গে থাকে আরাে বড়াে বড়াে লিঙ্গ এবং সবার হাতে হাতে পুরুষদের অবিকল লিঙ্গ সদৃশ খেলনা বা বস্তু। ফেস্টিভালের সময়ে প্রায় নগ্ন মেয়েরা সেখানে লিঙ্গ আকৃতির বিভিন্ন আইসক্রিম, ফাস্টফুড, খেলনা বিক্রি হয়। কেউ ইচ্ছে করলে সেগুলাে কিনে খেতে পারে, লিঙ্গের উপর বসতে পারে, লিঙ্গের সঙ্গে ছবি উঠতে পারে, লিঙ্গের মাথায় চুমুও খেতে পারে। সাধারণত মেয়েরা আবার এসব ব্যাপার খুবই আগ্রহী হয়ে থাকে। রাস্তায় রাস্তায় ছােটো থেকে বড়াে সবাইকে দেখা যায় পুরুষাঙ্গের আদলে তৈরি চকলেট আর আইসক্রিম চুষতে। অনেককেই ছবির জন্য পােজ দিতে দেখা যায় বিশালাকৃতির পুরুষাঙ্গের পাশে।……..

……শিবলিঙ্গকে অনেক সময় যােনিচিহ্ন (এটাকে অনেকে গৌরীপট্টও বলে) সহ তৈরি করা হয়। সব মিলিয়ে একটি মৈথুনরত প্রতীকই দৃশ্যমান হয়। যােনি হল মহাশক্তির প্রতীক। শিবলিঙ্গ ও যােনির সম্মিলিত রূপটিকে নারী ও পুরুষের অবিচ্ছেদ্য ঐক্যসত্ত্বা এবং জীবনসৃষ্টির উৎস পরােক্ষ স্থান ও প্রত্যক্ষ কালের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে পাশ্চাত্য গবেষকরা লিঙ্গ ও যােনিকে নারী ও পুরুষের যৌনাঙ্গ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তবে হিন্দুরা শিবলিঙ্গকে সৃষ্টির নারী ও পুরুষ উভয়ের অবদানের কথা……..

শিবপুরাণ, মার্কণ্ডেয় পুরাণ ইত্যাদি ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত আছে যে, একদা দুর্গার সঙ্গে যৌনমিলনকালে শিব এত বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন যে, তাতে দুর্গার প্রাণনাশের উপক্রম হয়। দুর্গা মনে মনে শ্রীকৃষ্ণকে স্মরণ করতে থাকেন, এমন সময় শ্রীকৃষ্ণ আবির্ভূত হয়ে নিজ সুদর্শন চক্র দ্বারা আঘাত করলে উভয়ের সংযুক্ত যৌনাঙ্গ কেটে আসে। ওই সংযুক্ত যৌনাঙ্গের মিলিত সংস্করণের নাম বাণলিঙ্গ বা শিবলিঙ্গ, যা হিন্দুসমাজের একটি প্রধান পূজ্য বস্তু এবং ওই শিবলিঙ্গের পুজোর জন্য বহু বড়াে বড়াে শিবমন্দির গড়ে উঠেছে। মঙ্গলপ্রদীপ জ্বালিয়ে কাসর ঘন্টা বাজিয়ে হিন্দুসমাজ মহাসমারােহে ওই শিবলিঙ্গ | পুজো করে থাকে। পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণশ্বরে শিবের সঙ্গমের অবস্থান প্রদর্শনের জন্য পরপর বারােটি মন্দির রয়েছে। ওই মন্দিরগুলিতে যৌনমিলনকালীন সময়ের বারাে প্রকারের প্রমত্রবস্থা প্রদর্শন করা হয়েছে। এতে প্রতিদিন হাজার হাজার মহিলা দর্শনার্থীর সমাগম হয়। এক শাস্ত্রীয় কাহিনিতে পাচ্ছি, দেবতারা সব একত্রে মিলিত হয়েছেন। উদ্দেশ্য রাসমেলার পরিদর্শন। কৈলাস থেকে আগত মহাদেব রাসমেলায় পরিদর্শনে ইচ্ছা প্রকাশ করলে শ্রীকৃষ্ণ কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরােপ করেন, যেহেতু সর্বাধিক বুদ্ধিমান শ্রীকৃষ্ণ সকল বিষয়েই অবগত। নিরাশ না-হয়ে মহাদেব ছদ্মবেশ ধারণ করে রাসমেলার উদ্দেশ্যে রওনা দিলে নৃত্যরত স্বল্পবসনা এক সুন্দরীকে দেখতে পান। সুন্দরী দেখে মহাদেবের লিঙ্গ বিশালাকার ধারণ করল। চতুঃপার্শ্বে ত্রাহি রব – হায়! এ যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ধ্বংস হবার শঙ্কা! অবশেষে শ্রীকৃষ্ণের পরামর্শে দেবদেবীদের সম্মিলিত প্রার্থনায় মহামায়া প্রকট হলেন। মহামায়া বিশ্বব্রহ্মাণ্ড-জোড়া মহাযােনি সৃষ্টি করলেন। মহাদেবের নিয়ন্ত্রণহীন বিশালাকার পুরুষদণ্ডকে ধারণ করে নিবৃত্ত করলেন, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডও অহেতুক বিনাশ থেকে রক্ষা পেল। সেই থেকে প্রচলন হল যােনিতে প্রােথিত মহাদেবের লিঙ্গপুজো। উল্লেখ্য যে, শিবরাত্রির বিশেষ ক্ষণে | শিবলিঙ্গকে স্নান করানাে পূর্বক অবিবাহিত তনয়ারা উত্তম পুরুষাঙ্গ-ধারী বীর্যবান প্রাপ্তির আশীর্বাদ লাভ করেন।”…….

…….পুরাণেই উল্লেখিত ভিন্ন একটি গল্প হল – কোনাে বিষয়ে পরীক্ষা নেওয়ার জন্য শিব সুন্দর পুরুষ সেজে বনমালা পরে উলঙ্গ অবস্থায় বালখিল্য ঋষিদের পাড়ায় আসেন ভিক্ষাছলে। তাকে দেখে কামার্ত ঋষিপত্নিরাও উলঙ্গ হতে চান এবং শিবকে নিয়ে টানাটানি করতে থাকেন। শিব জানান, পুরুষহীন কোনাে নির্জন স্থানে গেলে তিনি এই উলঙ্গতের কারণ বলবেন। এ সময় বালখিল্যরা এসে স্ত্রীদের পিটাতে থাকেন। এক পর্যায়ে এক ঋষিপত্নীর স্পর্শে খসে পরে শিবের লিঙ্গ এবং বাড়তে থাকে। শেষপর্যন্ত ব্রহ্মা এবং অন্যদের তবে তুষ্ট হয়ে শিব জানান, এই লিঙ্গের পুজো করলে জগতের শান্তি হবে। সেই থেকে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে প্রচলিত আছে শিবলিঙ্গের পুজো।………

বেশ্যা-বৃত্তান্ত

…………ভারতের প্রাচীন গ্রন্থাবলিতে, বিশেষ করে ৩৬ টি পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারতে প্রচুর বেশ্যার উল্লেখ পাওয়া যায়, যাঁরা “স্বৰ্গবেশ্যা” হিসাবে বিশেষ পরিচিত। যেমন – বিশ্বাচী, পঞ্জিকাস্থলা, সরলা, বিদ্যুৎপৰ্ণা, উর্বশী, মেনকা, রম্ভা, তিলােত্তমা, ঘৃতাচী, সুকেশী, মঞ্জুঘেষা, অলঘুষা, বিদ্যুৎপর্ণা, সুবাহু, সুপ্রিয়া উল্লেখযােগ্য। – এরকম কয়েক ডজন স্বৰ্গবেশ্যার নাম আমরা পাই। সংস্কৃত শব্দ অপূ (বাংলা অর্থ জল) হতে এদের উৎপত্তি তাই এদের অপ্সরা বলা হয়। আসলে এরাই স্বৰ্গবেশ্যা বলে পরিচিত। এরা নৃত্যে-সংগীতে পারদর্শী ছিলেন। এই কারণেই প্রাচীন সাহিত্যে এদের ইন্দ্রের সভা গায়িকা ও নর্তকী হিসাবে দেখা যায়। অপ্সরাদের অধিপতি ছিলেন কামদেব। অপ্সরা বা স্বৰ্গবেশ্যাদের সংখ্যা মােটামুটি ৬০ কোটি। দেবাসুরের সমুদ্র স্নানের সময়ে এরা সমুদ্রের ভিতর থেকে অসংখ্য নারীর সঙ্গে উঠে আসেন। কিন্তু কোনাে দেবতা ও দানবই তাদের গ্রহণ করতে রাজি হননি, কিন্তু পণ্য হতে কারাের বাধা ছিল না। প্রভাবশালী মানুষদের যৌনসুখ বিতরণ করে তাদের বিভ্রান্ত করাই ছিল এদের একমাত্র কাজ। তথাকথিত দেবতারা যখনই আসন্ন বিপদের গন্ধ পেতেন তখনই এইসব পরমা সুন্দরী বেশ্যানারীদের কাজে লাগাতেন। এরা মুনি-ঋষিদের ধ্যান নষ্ট করতেন। কিন্তু কেন দেবতারা এই বেশ্যাদের মুনি-ঋষিদের বিবশ করার কাজে লাগাতেন? কারণ হল বৈদিক যুগে কঠোর তপস্যার বলে কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে মুনি-ঋষিরা দেবতাদের চাইতেও বেশি ক্ষমতাশালী হয়ে পড়ার সম্ভাবনা ছিল। যাতে তারা দেবতাদের চেয়ে বেশি ক্ষমতাশালী হয়ে উঠতে পারে তাই তারা বেশ্যাদের লেলিয়ে দিতেন। শকুন্তলার জন্ম হয় বিশ্বামিত্র নামক ঋষির ধ্যানভঙ্গের কারণে। হিন্দু ধর্ম মতে ব্রাহ্মণগণ কঠোর তপস্যার ফলে তেবদা পর্যায়ে চলে যেতে পারতেন। বিশ্বমিত্র ঠিক তেমনই একজন ব্রাহ্মণ, কিন্তু তার উপর দেবতা ইন্দ্ৰ সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাই দেবতা ইন্দ্র তাকে ঈর্ষা করতেন, ইন্দ্র অনেক সময় তাকে ভয়ও করতেন। কারণ তিনি যদি দেবতাতুল্য হয়ে যান তবে ইন্দ্রের স্বর্গরাজ্যে এসে বিশ্বমিত্র হানা দিতে পারেন। দেবতা ইন্দ্র তার এই তপস্যা ভঙ্গের জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। আর এই ষড়যন্ত্রে ইন্দ্ৰ স্বৰ্গবেশ্যা মেনকাকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেন। বিশ্বমিত্রের তপস্যাতে দেবতারা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লে তার ধ্যান ভঙ্গ করার জন্য দেবতারা মেনকাকে পাঠায়। পবনদেবের প্ররােচনায় মেনকার শরীর থেমে সমস্ত বস্ত্র খুলে পড়ে। নৃত্যরত নগ্ন মেনকার রূপ-যৌবনে মুগ্ধ হয়ে বিশ্বামিত্রের ধ্যান ভঙ্গ হয়ে যায় এবং সংযম হারিয়ে বিশ্বামিত্র মেনকার সঙ্গে যৌনমিলনে লিপ্ত হয়, ফলে শকুন্তলার জন্ম….

……রম্ভা স্বৰ্গবেশ্যাদের মধ্যে অন্যতম। রম্ভাকে নিয়ে বেশ কয়েকটি মিথ পাওয়া যায় পৌরাণিক গ্রন্থগুলিতে। এগুলির মধ্যে অন্যতম হল – (১) রম্ভা কুবেরের পুত্র নবকুলের। নিকট অভিসার গমন কালে রাবণ তাকে দেখে কামমুগ্ধ হয়ে পড়েন। তাই রাবণ তাকে ধর্ষণ করেন। রম্ভা নবকুলকে এই ঘটনা বললে নবকুল রাবণকে অভিশাপ দেন, যদি রাবণ কোন নারীর অনিচ্ছায় তার প্রতি বল প্রয়ােগ করে ধর্ষণ করতে গেলে রাবণের মাথা সাত খণ্ডে বিভক্ত হয়ে যাবে। এই জন্যই সীতা রাবণ কর্তৃক অপহৃত হয়েও নিজের সতীত্ব রক্ষা করতে পেরেছিলেন। (২) এবার ইন্দ্র বিশ্বামিত্রের তপস্যা ভঙ্গ করার জন্য অপ্সরা রম্ভাকে প্রেরণ করেন। কিন্তু বিশ্বামিত্রের অভিশাপে রম্ভা শিলাতে পরিণত হয়ে ১০০০ বছর অবস্থান করেন। তখন ওই আশ্রমে শিলারূপে বাস করছিলেন তখন অঙ্গকার নামে একজন রাক্ষসী সেখানে নানা উপদ্রব করতে আরম্ভ করেন। তখন ওই আশ্রমে তপস্যারত শ্বেমুনি বায়ব্য অস্ত্রে ওই শিলাখণ্ড দুই ভাগে ভাগ করে রাক্ষসকে উদ্দেশ্য করে নিক্ষেপ করেন। অস্ত্রের ভয়ে ভীত হয়ে রাক্ষসী পলায়ন করে কপিতীর্থে এলে তার মাথায় সেই শিলাখণ্ড পড়ে রাক্ষসের মৃত্যু হয়। এই শিলাখণ্ড কপিতীর্থে নিমগ্ন হলে রম্ভা আবার নিজের রূপ ফিরে পান। (৩) ইন্দ্র সভায় নৃত্যকালে রম্ভার তালভঙ্গ হয়। তখন ইন্দ্ৰ ক্রুদ্ধ হয়ে রম্ভাকে অভিশাপ দেন, রম্ভা স্পন্দনহীন বিকলাঙ্গ হয়ে ভূতলে পতিত হন। পরে নারদের পরামর্শে শিবের পুজো করে পুনরায় স্বর্গে ফিরে যান। (৪) ইন্দ্রের আদেশে রম্ভা জাবালি মুনির তপােভঙ্গ করেন। মুনির ঔরসে রম্ভার এক কন্যা জন্মগ্রহণ করে। জাবালি এই কন্যার প্রতিপালন করেন; এই কন্যার নাম ফলবতী।। তিলােত্তমা দৈত্যরাজ নিকুম্ভের দুই পুত্র সুন্দ ও উপসুন্দ ব্রহ্মার কঠোর তপস্যা করে ত্রিলােক বিজয়ের জন্য অমরত্ব প্রার্থনা করেন। কিন্তু ব্রহ্মা এদের অমরত্বের বরদান করতে সম্মত হননি। তবে তিনি বলেন যে, স্থাবর-জঙ্গমের কোনাে প্রাণী তাদের ক্ষতি করতে পারবে না। যদি এদের মৃত্যু হয় তবে পরস্পরের হাতেই হবে। এই বর পাওয়ার পর তারা দেবতাদের উপর নিপীড়নে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তখন দেবতারা প্রাণ রক্ষা করার জন্য ব্রহ্মার নিকট প্রার্থনা করেন এদের নিকেশ করার জন্য। ব্রহ্মা এদের নিকেশ করার জন্য পরমা সুন্দর এক রমণীয় সৃষ্টি করলেন। ত্রিভুবনের সমস্ত উত্তম জিনিস তিল তিল করে সংগ্রহ করে ব্রহ্মা এক অতুলনীয়া নারী সৃষ্টি করেন। তিল তিল সুন্দর বস্তু মিলিত হয়ে এই সুন্দরী সৃষ্টি হয়েছিল বলে এর নাম হয় তিলােত্তমা। তিলােত্তমাকে সৃষ্টির পর ব্রহ্মা সুন্দ ও উপসুন্দরের নিকট পাঠিয়ে দেন। স্বৰ্গবেশ্যা তিলােত্তমা এদের দুজনের সামনে নগ্ন হয়ে নৃত্য করতে করতে থাকে। সুন্দ ও উপসুন্দ তিলােত্তমার রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে পাওয়ার জন্য পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হন। ফলে একে অন্যের হাতে নিহত হয়।….

……….উর্বশীও একজন পরমা সুন্দরী স্বৰ্গবেশ্যা। অভিশাপের ফলে উর্বশী মানুষরূপে জন্ম নেন। স্বৰ্গবেশ্যা উর্বশীকে দেখে বুধপুত্র পুরূষ প্রেমাসক্ত হয়। দুজন দুজনের প্রেমে মগ্ন। উর্বশীকে ছাড়া পুরূরবার চলে না। উর্বশী কয়েকটি শর্তে পুরূরবাকে বিয়ে করতে রাজি হয়। এর মধ্যে উল্লেখযােগ্য শর্তটি হল – উর্বশী যেন কোনাে দিন স্বামী পুরূরবাকে নগ্ন অবস্থান না দেখেন। যদি দেখেন তবে সেদিনই উর্বশী পুরূরবাকে ত্যাগ করবেন। পুরূরবা উর্বশীর সকল শর্ত মেনে নিয়ে বিয়ে করে। সুখেই তাদের দিন কাটছিল। এদিকে স্বর্গের দেবতারা উর্বশীকে ফিরিয়ে আনতে উঠেপড়ে লাগলেন। এক রাতে বিশ্বাবসু উর্বশীর প্রিয় দুটি মেষ চুরি করেন। পুরূরবা মেষদুটি উদ্বার করতে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থাতেই বিছানা থেকে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। ঠিক তখনই বিদ্যুতের প্ররােচনায় রাতের অন্ধকার ক্ষণিকের জন্য দূর হয়, সেই ক্ষণকালেই উর্বশী চোখের সামনে নগ্ন পুরূরবা প্রকট হয়ে পড়ে। শর্তমতে তখনই উর্বশী পুরূরবাকে ত্যাগ করে অদৃশ্য হয়ে যান। শােকাহত পুরূরবা পাগলের মতাে উর্বশীর সন্ধানে দেশবিদেশে ঘুরে-বেড়ায়। অনেকদিন পর অবশ্য সে অঙ্গরারূপে উর্বশীর দেখা পায়। চরিত্রবান পুরূরবা বর হিসাবে উর্বশীর সঙ্গে পুরাে জীবন কাটাতে ইচ্ছা প্রকাশ করেলে দেবতারা। তার ইচ্ছা পূরণ করেন এবং স্বর্গলােকে স্থান দেন। স্বর্গেরর আরও একজন প্রসিদ্ধ স্বৰ্গবেশ্যা ঘৃতাচী। ইনি ইন্দ্রের আদেশে নিজের নগ্ন রূপ দেখিয়ে বহু মুনিদের তপস্যা ভঙ্গ করেছেন। ঘৃতাচীকে দেখে ভরদ্বাজ ঋষির শুক্র স্বলিত হওয়ায় দ্রোণের জন্ম হয়। তাই দ্রোণের মাতা না হলেও তার জন্মের মূলে ছিলেন। ঘৃতাচী। চ্যান ও সুকন্যার পুত্র প্রমতির সঙ্গে ঘৃতাচীর মিলনে রুরুর জন্ম হয়। এবার ব্যাসদেব সুমেরু পর্বত থেকে নিজ আশ্রমে ফিরে একবার যখন হােমের আয়ােজন। করছিলেন, সে সময় ঘৃতাচী উপস্থিত হন। ঘৃতাচীকে দেখে ইনি অত্যন্ত কামাবিষ্ট হন। ব্যাসদেবের এরূপ অবস্থা দেখে ঘৃতাচী শুকপাখির রূপ ধরে পলায়ন করেন। কিন্তু ব্যাসদেবের প্রবল কামনার কারণে তার বীর্যস্খলন হয় এবং তা অরণির উপর পতিত হয়। ব্যাসদেব উক্ত অরণি মন্থন করতে থাকলে একটি পুত্রের জন্ম হয়। ঘৃতাচী। শুকপাখির রূপ ধরে পলায়ন করেছিলেন বলে ব্যাসদেব এর নাম রাখেন শুক।

এইসব বেশ্যারা ছিলেন অনন্তযৌবনা, তাই “দেবরাজ ইন্দ্র গুপ্তচরবৃত্তি এবং গুপ্তহত্যার কাজে নিয়ােগ করতেন। রামায়ণে তাে প্রচুর বেশ্যা এবং গুপ্তচর বৃত্তির কাজে রূপাজীবা নিয়ােগের কথা উল্লেখ আছে। রামচন্দ্রের অভিষেকের সময় প্রচুর বেশ্যা অংশগ্রহণ করেছিল। রামায়ণের যুগে বিশিষ্ট অভ্যাগতদের অভ্যর্থনায় এ রাজপরিবারের মানুষদের মৃগয়ায় বেশ্যা বা গণিকাদের নিয়ােগপ্রথা চালু ছিল। গণিকা কর্তৃক ঋষ্যশৃংগের প্রলােভন আখ্যান রামায়ণে সুখ্যাত হয়ে আছে। মহাভারতের যুগে “বিষকন্যা” নামক এক শ্রেণির সুন্দরী গণিকাদের কথা জানা যায়। এরা খুনে গুপ্তচর বাহিনীর সক্রিয় সদস্য ছিলেন। কাজ ছিল – যৌনসম্ভোগকালে ওষ্ঠ-চুম্বনে অথবা দন্ত দংশনে এরা হত্যার জন্য প্রেরিত ব্যক্তির শরীরে বিষ ঢেলে দিত। সেই ব্যক্তি জ্ঞান হারালে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করত এবং পুরুষাঙ্গটিও কেটে ফেলা হত। বিষকন্যা গণিকাদের সবচেয়ে বেশি আধিক্য দেখা যায় ভারতবর্ষে মৌর্য সাম্রাজ্যের সময়। বিশাখদত্তের “মুদ্রারাক্ষস” নাটকের প্রথম ও দ্বিতীয়াংশে এক বিষকন্যার উল্লেখ আছে, যে নন্দরাজের মন্ত্রী রাক্ষস নিয়ােগ করেছিলেন। চন্দ্রগুপ্ত (মৌর্য)-কে হত্যা করার নিমিত্তে। এহেন বিষকন্যারা একাধারে বহুপুরুষগামী, অপরদিকে হত্যাকারীও। মহাভারতের যুগে এমন জনা পাঁচেক বিখ্যাত মুনিঋষির নাম উল্লেখ করা যায়, যাঁরা “স্বৰ্গবেশ্যা”-দের দেখে কামার্ত হয়ে তাঁদের সঙ্গে যৌনসংসর্গে মিলিত হয়েছিলেন। বিশ্বামিত্র, শরদ্বান, ভরদ্বাজ, ব্যাস, বশিষ্ট, পরাশর, দীর্ঘতমা – এরাই সেইসব গুণধর ! মহাভারতের যুগে অপরাপর সম্মানজনক বৃত্তিগুলির মধ্যে গণিকাবৃত্তিই ছিল অন্যতম। রাজদরবারে ও বিবিধ রাজকীয় অনুষ্ঠানে গণিকাদের উপস্থিতি ছিল অপরিহার্য। এরা মনােহর রত্ন সােনা ও মণিমুক্তাখচিত অলংকারাদি ও মহামূল্য পােশাকে আচ্ছাদিত হয়ে তারা রাজপথে অবাধে বিচরণ করতেন। যে-কোনাে অনুষ্ঠান ও শােভাযাত্রার আয়ােজন হলে পুরােভাগে বস্ত্রালংকারে শােভিত সুন্দরী বেশ্যারা থাকতেন। শুধু সুরলােকেই নয়, দেবলােকেও বেশ্যাদের প্রয়ােজনীয়তা ছিল যথেষ্ট, উপস্থিতিও ছিল লক্ষ্যণীয়। মহাভারতে ত্বষ্টা নামক এক ঋষির কথা জানা যায়। ত্বষ্টার পুত্র ছিলেন একাধারে মদ্যপ এবং নিষ্ঠাবান ধার্মিক। তাঁর উদ্দেশ্য স্বর্গর্জয়। স্বভাবতই স্বর্গরাজ ইন্দ্রের ভয়ের কারণ হল ত্রিশিরা। উপায় খুঁজতে বেশ্যাদের শরণাপন্ন হলেন ইন্দ্র। ত্রিশিরার তপস্যা ভঙ্গ করতে সুন্দরী বেশ্যাদের কাজে লাগালেন দেবরাজ ইন্দ্র। মহাভারতের যুগে সমরসম্ভারের সঙ্গে সৈন্যশিবিরে সুন্দরী বেশ্যাদেরকেও স্থান দেওয়া হত। সেনাদের একঘেয়েমি নিবারণও মনােরঞ্জনের জন্য শত সহস্র বেশ্যা নিয়ােগ করা হয়েছিল। পাণ্ডব সেনাশিবিরে যে সব সুন্দরী “বেশস্ত্রী” অর্থাৎ বেশ্যাদের নিয়ােগ করা হয়েছিল তাঁদের সুযােগসুবিধা যা কিছু দেখভালের দায়িত্ব সবই ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের উপরই ন্যস্ত ছিল। রামায়ণের রামচন্দ্রের জন্য যে স্বতন্ত্র সৈন্যবাহিনী গঠন করেছিলেন সেই বাহিনীতে বিবিধ সমরসম্ভারেও অজস্র যৌবনবতী নিয়ােগ করা হয়েছিল।

প্রাচীন যুগে বেশ্যাদের বিবরণ বর্ণনা করতে চাইব বাৎস্যায়নে “কামসূত্র” উল্লেখ করব না  তা হয় নাকি! সবার আগে সংক্ষেপে জেনে নিই কী আছে বাৎস্যায়নের “কামসুত্র”-এ। আছে নরনারীর কামকলার যাবতীয় তথ্য, এবং প্রয়ােজনীয় সমস্ত কিছুর বিশদ বর্ণনা। আছে লিঙ্গের দৈর্ঘ্য ও যােনির বিস্তারর অনুসারে নরনারীর প্রকারভেদ, স্বভাব অনুসারে নারীর বৈশিষ্ট্য-চুম্বন-আলিঙ্গনাদি, নমর্দন, দংশনক্ষত, নখক্ষত, যৌনমিলনের বিভিন্ন ভঙ্গি তথা আসন এবং প্রয়ােগবিধি, পত্নী নির্বাচন, পত্নী এবং উপপত্নীর লক্ষণ, পরস্ত্রীকে বশীভূত করার উপায়, কৃত্রিম লিঙ্গের ব্যবহার, যােনির বিস্তৃতি এবং সংকোচনের উপায়, বিভিন্ন প্রকার বিবাহ, পরস্ত্রীর সঙ্গে যৌনমিলন, রতিক্রিয়ার উপযুক্ত স্থান প্রভৃতি। এই “কামসূত্রম্”-এর বৈশিক’ নামে একটি বিস্তৃত অধিকরণে প্রাচীনকালে ভারতীয় বেশ্যাদের জীবনযাত্রার একটি সুস্পষ্ট এবং সম্পূর্ণ বিবরণ পাওয়া যায়। এই বিবরণ থেকেই সাধারণের মনে বেশ্যাদের সম্পর্কে যে অবজ্ঞা, ঘৃণা এবং অশ্রদ্ধার বিরূপ ধারণা আছে বাৎস্যায়নের উল্লিখিত বেশ্যাদের জীবনযাত্রার বর্ণনা হৃদয়ঙ্গম করলেই সেই বধ্যমুল ধারণার বদল হতে পারে।……..

……….এমনকি বেশ্যাদের কামশাস্ত্রে পারদর্শিতা লাভ করতে হলে সবার আগে ৬৪ কলায় নিপুণতা লাভ করতে হবে। প্রসঙ্গক্রমে ৬৪ কলাগুলি জেনে নিতে পারি – (১) সংগীত, (২) বাদ্য, (৩) নৃত্য, (৪) অঙ্কন, (৫) তিলক-কাটা (সেই সময়ে ললাটে-কপােলে-স্তনে, এমনকি নাভিও হাতে-পায়ে তিলক কাটার রীতি ছিল), (৬) তণ্ডুল-কুসুম-বলি-বিকারের ব্যবহার, (৭) পুষ্পস্তরণ (যে বিছানায় যৌনক্রিয়া চলবে সেটি ফুল দিয়ে সাজিয়ে রাখতে হবে), (৮) দশনবসনাঙ্গরাগ (নিজের দেহবল্লরী চিত্রিত করতে হবে)………

………বাৎস্যায়নের সময় বেশ্যাদের বিয়ের মধ্যে এক অভিনব ব্যাপার ছিল। আর পাঁচটা সাধারণ মেয়েদের মতাে তাদেরও বিয়ে-থা, সন্তান জন্মদান, ঘর-সংসার করতে পারত। তবে কোনাে বেশ্যাকেই বিয়ের পর পুরােনাে বেশ্যাবৃত্তিকে ত্যাগ করতে হত না। এমনকি স্বামীর দিক থেকেও বেশ্যা-স্ত্রীর বেশ্যাবৃত্তির বিরুদ্ধে অভিযােগ করত না। অবশ্য বিয়ের পর প্রথম একটা বছর স্বামী ছাড়া অন্য কোনাে পুরুষের সঙ্গে যৌনমিলন করা নিষিদ্ধ ছিল। বিয়ের এক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর বেশ্যাবৃত্তিতে আর কোনাে বাধা ছিল না। তবে সেক্ষেত্রে শর্ত একটাই – এক বছর পর স্বামী যে রাতে তাকে যৌনমিলনের নিমিত্ত বিছানায় আহ্বান করবে সেই মুহূর্তে শত খরিদ্দার ত্যাগ করে সেই রাতে তাকে স্বামীর সঙ্গে যৌনকর্মে লিপ্ত হবে। (কাম-সূত্রম্ ৭/১/২২)।………

………..ভবভূতির “মালতীমাধব”-এ ব্রাহ্মণ মাধৰ সিংহলে বাণিজ্য করে প্রভূত সম্পদশালী হন। এরপর কুবলয়াবলি নাম্নী এক সুন্দরী গণিকার প্রেমে পড়েন এবং যৌনমিলন কার্য সম্পাদন করেন। ব্রাহ্মণের মােহাবিষ্টদতার সুযােগ নিয়ে সেই বেশ্যারমণী তার সমস্ত সম্পত্তি হাতিয়ে নেয়। পরে অবশ্য কুবলয়াবলিকে পাকড়াও করে নাক-কান কেটে প্রেমিকা মালতীর কাছে ফিরে যান মাধব। এই হল “মালতীমাধব”-এর উপজীব্য। সপ্তম শতকের লেখক বানভট্ট তার “কাদম্বরী” গ্রন্থে জানিয়েছেন, সেকালে গণিকারা দেশের রাজাকে স্নান করাত। রাজার মাথায় আমলকী ঘষে দিতে। স্নানের পর রাজার শরীরে চন্দন, আতর, কুমকুম ইত্যাদি মাখিয়ে দিত। এমনকি রাজার পরনের যাবতীয় পােশাক বেশ্যারাই পরিয়ে দিতেন। “চারুদত্ত” গ্রন্থে লেখক ভাসের কাহিনি উপজীব্য হল চারুদত্ত ও বসন্তসেনার প্রেম। এখানে চারুদত্ত নামে জনৈক ব্রাহ্মণের সঙ্গে বেশ্যা বসন্তসেনার বিয়ে হয়। এছাড়া শর্বিলক নামে এক ব্রাহ্মণের সঙ্গে মনিকা নামক বিয়ের কাহিনিও এই গ্রন্থে আছে।………

……….ধর্মীয় সংস্কার-আচার-প্রথা ও পবিত্র পতিতা’রজন্ম দিয়েছে। লােকজীবনে দেহসাধনার নামে যে অবাধ যৌনাচার চলে আসছে তাতে ভণ্ড পির, কামুক সাধু কিংবা বৈরাগী-বৈষ্ণবের আখড়াও বাদ যায় না। “তন্ত্রসার” গ্রন্থে ভুরি ভুরি বেশ্যার উল্লেখ আছে। এই গ্রন্থে বেশ্যারমণীদের চারভাগে ভাগ করা হয়েছে – যেমন (১) গুপ্তবেশ্যা । এই বেশ্যারা সাধারণত তন্ত্রসাধক বা তান্ত্রিকদের বংশজাতা হয়। এরা স্বভাবে নির্লজ্জ এবং অত্যধিক কামাসক্ত হন। এরা পশুভাবাপন্ন স্বামী বা পুরুষ পছন্দ করেন।(২) মহাবেশ্যা ঃ এই মহাবেশ্যারমণীরা স্বেচ্ছায় শরীরের পােশাক ত্যাগ করে গুপ্ত-অঙ্গ প্রদর্শন করেন। (৩) রাজবেশ্যা রাজবেশ্যারা স্বাধীনভাবে নগরে বিচরণ করণে এবং রাজার মতােই আচরণ করেন (৪) দেবেশ্যা ঃ যে রমণী মন্ত্র উচ্চারণের সঙ্গে লন্ত্রিক-চক্রে অধিষ্ঠিতকালে যৌনমিলন সম্পাদনের মাধ্যমে গর্ভবতী হন, সেই নারীর গর্ভজাত কন্যাই দেববেশ্যা নামে অভিহিত করা হয়।

নিরুত্তরতন্ত্রে আবার মােট ছয় প্রকারের বেশ্যার উল্লেখ আছে। যেমন -(১) গুপ্তবেশ্যা, (২) মহাবেশ্যা, (৩) কুলবেশ্যা, (৪) রাজবেশ্যা, (৫) ব্রহ্মাবেশ্যা এবং (৬) মহােদয়া। এক্ষেত্রে বলা হয়েছে এইসব বেশ্যারা এক-একটি প্রসিদ্ধ তীর্থতুল্য। যেমন – গুপ্তবেশ্যারা অযােধ্যা তীর্থতুল্য, মহাবেশ্যারা মথুরা তীর্থতুল্য, কুলবেশ্যাগণ মায়া তীর্থতুল্য, রাজবেশ্যাগণ দ্বারকা ও অবন্তী তীর্থ তুল্য, ব্রহ্মবেশ্যাগণ দ্বারাবতী তীর্থতুল্য এবং মহােদয়া বেশ্যারা কালিকাতীর্থতুল্য। নিরুত্তরতন্ত্রে বলা হয়েছে, “স্ত্রী পুংসাে সঙ্গমে সৌখ্যং জায়তে তং পরমং পদম্”। অর্থাৎ, স্ত্রী ও পুরুষের সঙ্গমে যে সৌখ্য বা আনন্দ তাই-ই পরমপদ বা ব্রহ্ম। সেই কারণেই তন্ত্র সাধনার ক্ষেত্রে ‘পঞ্চ ম-কার অপরিহার্য অঙ্গ। পঞ্চ ম-কার হল মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা এবং মৈথুন। “বিনা পীত্বা সুরাং ভুক্কা মৎস্যমাংসং রজস্বলাং।/ যাে জপে দক্ষিণাং কালীং তস্য দুঃখ পদে পদে”।। –অর্থাৎ “যে বিনা মদ্যপানে, বিন মাছমাসং খেয়ে, বিনা যুবতী সম্ভোগে দক্ষিণা কালীর আরাধনা করবে তার পদে পদে দুঃখ হবে”।

শাস্ত্রের পাশাপাশি ইতিহাসের সাক্ষ্যও দুর্লভ নয়। বাংলার তাম্রশাসন আমলের লেখমালায় সংগীত-নৃত্য পটিয়সী রাজনটী ওরফে রাজবেশ্যাদের পরিচয় মেলে। ধর্মীয় আচারের আড়ালেও আবার কখনাে বেশ্যা ও বেশ্যাবৃত্তির জীবনযাপন করতে হয়েছে। দেবদাসী প্রথা তার একটি | বড়াে দৃষ্টান্ত। কালীঘাটের পটচিত্রে বেশ্যাসম্ভোগের দৃশ্য যেমন আছে, তেমনই অনেক মন্দিরের গায়ে উৎকীর্ণ টেরাকোটাতেও এমন দৃশ্য মেলে। পাশ্চাত্য শিক্ষার আনুকুল্যে উনিশ শতক বাঙালি সমাজের সার্বিক উত্থানের কাল হয়ে উঠেছিল। অবশ্য এর পাশাপাশি সমাজ-অভ্যন্তরে অনাচারের একটি চোরাস্রোতও বহমান ছিল। উঁইফোড় নব্যধনী এবং সেই সঙ্গে শিক্ষিত সম্প্রদায়ের একাংশের মধ্যেও চারিত্রিক ভ্রষ্টাচার দেখা দেয়। এমনকি সমাজের নেতৃস্থানীয় খ্যাতিমান ব্যক্তিবর্গের কেউ কেউ এই নৈতিক স্খলন থেকে মুক্ত ছিলেন না। সুরাপান, বেশ্যাসক্তি ও রক্ষিতা-পােষণ সেকালে এক ধরনের সামাজিক স্বীকৃতি লাভ করেছিল। কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে গণিকাচর্চা গৌরব ও মর্যাদার প্রতীক হিসাবে বিবেচিত হত। আঠারাে-উনিশ শতকে কলকাতার নাগরিক জীবন এমনকি মফস্বল শহরেও গণিকাচর্চা জীবনযাত্রার অনিবার্য প্রয়ােজনীয় অনুষঙ্গ হয়ে উঠে। নববাবু সমাজে ‘বেশ্যাবাজি’ ছিল বাবুগিরির প্রধান অঙ্গ। আমাদের রথী-মহারথীদের কিছু নাম জেনে নেই যারা হামেশাই বেশ্যাবাড়ি যেতেন। ভারতপথিক রাজা রামমােহন রায় নিকির নাচ দেখেই সন্তুষ্ট ছিলেন না, বাধা রক্ষিতাও ছিল তার। এই যবনী রক্ষিতার গর্ভে তার একটি পুত্রও জন্মে ছিল। দ্বারকানাথ ঠাকুরের বাগান বাড়ি বিলাস ও বাইজি আসক্তি তার সাধ্বী পত্নী বরদাস্ত করেননি। দ্বারকানাথকে বহির্বাটীতেই রজনী যাপন করতে হত, অন্দরমহলে প্রবেশর্তর জন্য নিষিদ্ধ হয়েছিল। কলকাতার বউবাজারে দ্বারকানাথের পরিবারের কোনাে সদস্যের মালিকানায় ৪৩ কক্ষের এক বিশাল বেশ্যাবাড়িও ছিল। কারও কারও ধারণা, নটী সুকুমারী দত্তের প্রেমে মজেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর – কাদম্বরী দেবীর আত্মহত্যার কারণ নাকি এই অবৈধ সম্পর্ক। ব্যভিচারী রমেশদার আত্মকথায় ঠাকুরপরিবার সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর কিছু তথ্যের সন্ধান মেলে। প্রতিবেশী সম্পন্ন মুসলমান সম্প্রদায়ও এই হিন্দু বাঙালি’বাবুদের অনুসরণ করতেন। পদমদীয় নবাব মির মহম্মদ আলি তাদেরই একজন। সত্যনিষ্ঠ মশাররফ অকপটে তার ডায়েরিতে লিখে গেছেন, গ্রামের বাড়ি লাহিনীপাড়ায় থাকায় সহজে শহরে যাওয়ার প্রয়ােজন বা সুযােগ হত না। কিন্তু যেদিন হাতের কাছের শহর কুষ্টিয়ায় যাওয়া পড়ত সেদিন ছয়মাসের ‘দাদ’ একদিনে তুলে নিতেন, নিজে মজে অবিদ্যাদের মজিয়ে, উৎসবের আনন্দে শহরে অবস্থানের প্রায় পুরােটা সময়ই কাটিয়ে আসতেন বেশ্যাপাড়ায়। দেশীয় গণিকা শুধুনয়, ‘ই-বঙ্গ বারাঙ্গনা’র প্রতিও হাত বাড়িয়েছিলেন এবং তাকে সন্তানও উপহার দিয়েছিলেন। মরমি কবি হাসন রাজার তাে হর হামেশাই পতিতা দর্শনে যেতেন। হাসন রাজার জ্যেষ্ঠ পুত্র দেওয়ান গনিউর রাজার বেশ্যাসক্তির বিবরণ তার সফরভিত্তিক আত্মকথায় মেলে। কবি নজরুল তাে কাননবালার ঘরে প্রায় নিয়মিতই যেতেন। কথা শিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবনে পতিতা ও বৈধতাও প্রশ্নহীন নয়। সাহিত্যিক জগদীশ গুপ্তও রক্ষিতা পুষতেন।…….

…….অর্থের বিনিময়ে যৌনতা বিক্রির ইতিহাস সুপ্রাচীন। ওয়েবস্টার অভিধান মতে, সুমেরিয়ানদের মধ্যেই প্রথম পবিত্র বেশ্যা বা পতিতার দেখা মেলে। প্রাচীন গ্রন্থাদিসুত্রে, যেমন ইতিহাসের জনক হিসেবে খ্যাত হিরােডেটাস (খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৪ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৪৩০/২০)-এর লেখায় এই পবিত্র বেশ্যাবৃত্তির বহু নমুনা পাওয়া যায়, যেটি প্রথম শুরু হয়েছিল ব্যাবিলনে। সেখানে প্রত্যেক নারীকে বছরে অন্তত একবার করে যৌনতা, উর্বরতা ও সৌন্দর্যের দেবী আফ্রোদিতির মন্দিরে যেতে হত এবং সেবাশুশ্রুষার নমুনা হিসাবে একজন বিদেশির সঙ্গে নামমাত্র মূল্যে যৌনসঙ্গম করতে হত। একই ধরনের বেশ্যা বৃত্তির চর্চা হত সাইপ্রাস এবং করিন্থেও। এটি বিস্তৃত হয়েছিল সার্দিনিয়া এবং কিছু ফিনিশীয় সংস্কৃতিতে, বিশেষ করে ইস্টার দেবতার সম্মানে। ফিনিশীয়দের মাধ্যমে ক্রমশ এটি ভূমধ্যসাগরের অন্যান্য বন্দর শহরগুলােতেও সংক্রমিত হয়ে পড়ে। যেমন—সিসিলি, ক্ৰটন, রােসানাে ভাগলিও, সিক্কা ভেনেরিয়া এবং অন্যান্য শহরে। এক্ষেত্রে অনুমান করা হয় এশিয়া মাইনর, লাইদিয়া, সিরিয়া ও এট্রাকসনের নামও।ইসরায়েলে এটি একটি সাধারণ ব্যাপার ছিল। পাশ্চাত্য সভ্যতার জতুগৃহ প্রাচীন গ্রিকের এথেনাইয়ের কবি সােলােন (খ্রিস্টপূর্ব ৬৩ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৫৯০), যিনি তকালীন গ্রিকের সাতজন জ্ঞানী লােকের একজন হিসাবে গণ্য হতেন, খ্রিস্টপূর্ব ছয় শতকে এথেন্সে প্রথম বেশ্যালয় স্থাপন করেন। এই বেশ্যালয়ের উপার্জন দিয়ে আফ্রোদিতিকে নিবেদন করে একটি মন্দির নির্মাণ করা হয়েছিল। মধ্যযুগে ইউরােপে ব্যাপকভাবে বেশ্যাবৃত্তি। ছড়িয়ে পড়ে এবং পৌরসভার মাধ্যমে বেশ্যালয়গুলি পরিচালিত হতে থাকে।………

………..ভারতের কয়েকটি প্রদেশে রাজাদের অধীনে নাইক’নামে একটি সম্প্রদায় ছিল। নাইক মেয়েরা সংসারের ব্যয় নির্বাহের জন্য বেশবৃত্তি গ্রহণে বাধ্য হত। এনসাইক্লোপিডিয়ার ভাষ্য মতে, নগরসভ্যতা বিকাশের ফলে ক্রমশ যৌনতার প্রসার ঘটতে থাকে। ভুমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের লিভিয়ান ও সাইপ্রিয়ান জাতির মেয়েরা দূরবর্তী অঞ্চলগুলিতে গিয়ে বেশাবৃত্তি করে অর্থ সংগ্রহ করে নিয়ে আসত। পুরােহিতরা সে সময় ধর্মের নামে কখনাে-কখনাে মেয়েদেরকে বেশ্যাবৃত্তিতে নিয়ােজিত করত। চিনে তাঙ রাজবংশ একটি নির্দিষ্ট এলাকায় বেশ্যাবৃত্তি চালু করেছিল। পরবর্তী “সাঙ” রাজবংশ বিভিন্ন স্থান থেকে পতিতাদের সংগ্রহ করে “হাঙ চৌ”শহরে সীমাবদ্ধ করে দেয়, অর্থাৎ তৈরি হয় একটি নির্দিষ্ট পতিতালয়। সেটা একাদশ শতাব্দীর ঘটনা। বহু আগে প্রাচীন গ্রিস ও রােমে এ ধরনের পতিতাবৃত্তির উৎপত্তি। এ ধরনের মানে হল নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে রেখে পেশা হিসাবে স্বীকৃতি আলয় নির্মাণ করেছিলেন। প্রাচীন হেল্লাস বা গ্রিস দেশের আথেনাই বা এথেন্সে বেশ্যালয় ছিল-ছিল ব্যাপকভাবে বেশ্যাবৃত্তি। পৃথিবীতে প্রথম বেশ্যাবৃত্তি পেশার মতাে লাইসেন্স বা নিবন্ধন দেওয়া ও কর ধার্য করা হয় রােমান আমলেই। সে আমলে চিন, ভারতবর্ষসহ অনেক দেশেই পতিতাবৃত্তি ধর্মীয় উপাসনার সঙ্গে যুক্ত ছিল। মহাভারতের সমাজে প্রান্তবাসিনী ছিলেন না। শহুরে সংস্কৃতিতে বেশ্যারা যে। এক তাৎপর্যময় স্থান অধিকার করেছিল সে কথা মেলে মহাভারতের অনেক গর্বে, সে কথা আগেই বলেছি। বল্লালসেনের রাজত্বকালে প্রবর্তিত হয় কৌলিন্য প্রথা। মুলত এটাই এক ধরনের পতিতাবৃত্তি বলে মনে করে অনেকে। কুলীন ব্রাহ্মণ পুরুষেরা অর্থের বিনিময়ে ঘরে ঘরে গিয়ে বিয়ে করে আসত। এভাবে একেক জনের শতাধিক স্ত্রী থাকত। কিন্তু ব্রাহ্মণেরা সবাইকেই সময় দিতে পারত না। ফলে কখনাে কখনাে অতৃপ্ত যৌবনবতী স্ত্রীরা লিপ্ত হত ব্যাভিচারে, মেতে উঠত বেশ্যাবৃত্তিতে।………..

…….প্রাচীন যুগে বেশ্যাদের প্রকারভেদ পূর্বেই আলােচনা করেছি। সময় বদলেছে, সময় বদলেছে সর্বত্র। বেশ্যাবৃত্তির ধরনেও আমূল পরিবর্তন এসেছে। এসেছে নতুন ধরনের বিভাজন।

(১) Street Prostitute এরা ক্লায়েন্ট বা খরিদ্দার ধরার জন্য বিভিন্ন রাস্তায়, পার্ক বা অন্যান্য পাবলিক জায়গা, রাস্তায় পাশে, যানবাহন বা সংকীর্ণ কোনাে ঘুপচিতে যৌনক্রিয়া বা যৌন-পরিসেবাসম্পন্ন করে থাকে।

(২) BrothelBrothel বা বেশ্যালয় বা কোঠিতে ঘর ভাড়া দিয়ে বা ঘর ভাড়া নিয়ে ঘঘাষিতভাবে যৌনকাণ্ড চালানাে হয়। এখানকার রাস্তার তুলনায় উন্নত নিরাপত্তা এবং রােজগারের নিশ্চয়তা বেশি। কোনাে কোনাে দেশে এরা কর্তৃপক্ষ দ্বারা লাইসেন্সকৃত।

(৩) Escort এই যৌনকর্মীরা ফোন করে বা হােটেল কর্মীদের মাধ্যমে বা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বা সেক্রেটারি বা এজেন্টের মাধ্যমে খরিদ্দারের সঙ্গে পারিশ্রমিকে রফা করে যৌনকর্মে লিপ্ত হয়। এটি হল যৌনকর্মের সবচেয়ে গােপন এবং আধুনিক ফর্ম। এরা ক্লায়েন্টের বাড়ি অথবা হােটেল-রিসর্ট, সার্কিট হাউসে মিলিত হন। তবে যে-কেউ এদের শরীর-সঙ্গ লাভ করে পারেন না। সমাজের উচ্চ মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তদের মধ্যেই সাধারণত সীমাবদ্ধ থাকে। কারণ এরা তুলনামূলকভাবে কস্টলি বা ব্যয়বহুল।

(4) Private এরা ব্যক্তিগতভাবে শাঁসালাে ক্লায়েন্ট খুঁজে নিয়ে স্বাধীনভাবে কোনাে বিলাসবহুল হােটেলে যৌনক্রিয়া করেন এবং তা অত্যন্ত গােপনে সম্পন্ন হয়। এদের পারিশ্রমিকও বেশ তুঙ্গে থাকে। এরা ভ্রমণসঙ্গী হিসাবেও ক্লায়েন্ট সংগ্রহ করে ক্লায়েন্টের ঘাড় ভেঙে দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ায়।(৫) Window or doorwayঃজানালা বা প্রবেশপথের মাধ্যমে বেশ্যালয়ের বেশ্যারা ক্লায়েন্টকে আহ্বান করেন। উইন্ডােরা সাধারণত উষ্ণ জায়গা পছন্দ করে এবং ডােরওয়েরা সাধারণত ঠান্ডা জায়গাই পছন্দ করে।

(৬) Club, Pub, Bar, Karaoke Bar, Dancehall ঃ এই ধরনের বেশ্যারা ক্লাব, পাব, বার, কারাওকে বার, নাচ হল, মদ ইত্যাদি টুকিটাকি জিনিস খুচরাে বিক্রির স্থানগুলি থেকে ক্লায়েন্টদের যৌনমিলনের জন্য আবেদন রাখেন।

(৭) Other all-made venues এইসব বেশ্যারা যেখানেই নিয়মিত পুরুষের সমাবেশ (যেমন সেনাছাউনি, বাজার-ঘাট, ব্যস্ত রেলস্টেশন ও বাসস্টপ, খনি-ক্যাম্প, অপেক্ষারত ট্রান্সপাের্ট ইত্যাদি) সেখানেই হাজির হয়ে ছুকছুকে পুরুষদের কাছাকাছি এসে যৌনমিলনে আহ্বান করে।

(৮) Door knock or hotel : এঁরা হােটেলে বসবাসরত পুরুষদের যৌনমিলনে আহ্বান করে।

(৯) Transport (Ship, Truck, Train) ঃ এইসব বেশ্যাগণ চলমান বাস, ট্রেন, জাহাজে উঠে ভ্রমণরত যাত্রীদের যৌনমিলনে আহ্বান করে।

(১০) CB radio এইসব যৌনকর্মীগণ সম্ভাব্য ট্রাক ড্রাইভার ক্লায়েন্টদের সঙ্গে এক্সচেঞ্জ (অপভাষা) বার্তা CB রেডিও ব্যবহার করে হাইহয়ে বরাবর ড্রাইভ করে ট্রাক স্টপ বা পার্কিং এলাকায় যৌন-পরিসেবা দেয়।

(১১) other methods of solicitation ঃ বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে, যেমন নােটিশ বাের্ড এবং সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন, মােবাইল ফোন নম্বর সহ ‘যৌন কর্মীক্যাটালগ, ইন্টারনেট মাধ্যমে ভার্চুয়াল পতিতালয় এবং অন্যান্য অন্তরঙ্গ স্থানগুলিতে যৌন-পরিসেবা বিতরণ করা হয়। (১২) Phone-Sex with Recharge এই এক ধরনের যৌনকর্মীর দেখা মেলে যারা মােটা অঙ্কের মােবাইল রিচার্জেরশর্তেরগরগে ফোন-সেক্স করে থাকে। (১৩) Massage Parlour ঃ বিভিন্ন ম্যাসাজ পার্লার, বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, নামি-দামি বিউটিপার্লারে মেল টু মেল, মেল টু ফিমেল, ফিমেল টু মেল, ফিমেল টু ফিমেল ম্যাসাজ দেওয়া হয়। প্রথমে মিনিট দশেক ক্লায়েন্টকে নগ্ন করে শুইয়ে ম্যাসাজ করা হয়। এই ম্যাসাজটুকু ক্লায়েন্ট সন্তুষ্ট হলে তার মূল্য একরকম হয়, যদি ক্লায়েন্ট আরও বেশি চায় বা যৌনমিলনে আগ্রহী হন তবে তার মূল্য একটু চড়াই হয়। এ পর্যায়ে প্রতি ঘন্টায় স্লাভে মূল্য নির্ণয় হয়। আজকাল বেশ্যালয়ের অন্দরমহলেও এরকম ম্যাসাজ পার্লারের ব্যবস্থা রাখা হয়।…………….

………..(৪) পর্নোছবির বেশ্যা : মােটা টাকার হাতছানি এড়ানাে যে খুব কঠিন, তা বিশ্বের পয়লা নম্বর পর্নস্টার সানি লিওন একাধিক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তার সেক্স করাটা প্যাশন। তিনি স্ব-ইচ্ছায় এই পেশা বেছে নিয়েছেন। স্টেইট, লেসবাে – সব ধরনের সেক্স করতে সানি লিওন সমান পারদর্শী। পর্ন-বাজারে সানি লিওন মুকুটহীন সম্রাজ্ঞী। কোটি টাকা তার দাম। ন্যুড ফোটো-সেশন দিয়ে তার যৌনজীবন শুরু করেছিলেন, তার পর বিশ্বের এক নম্বর পর্নস্টার। ৩৫ উর্ধ্ব প্রায় বিগত যৌবনা সানি লিওন বর্তমান বলিউডে অভিনেত্রী হিসাবে বাকি জীবনটা কাটাতে চান বলে অনেকে মনে করেন। স্বামী ড্যানিয়েল ওয়েবর সহ সানি লিওন প্রায় ৫৬টি পর্নছবিতে সেক্সপ্লে করেছেন এবং ৫৯ বুড্রিমও পরিচালনা করেছেন। শুধু সানি লিওন নয় – প্রিয়া অঞ্জলি রাই, দেবিকা, রেশমা, শাকিলা, Peta Jensen, Lisa Ann, Hitomi Tanaka, Christy Mack, Natasha Dalce, Kristina Rose, Holli Sweet, Alexa Loren, Olivia Lovely প্রমুখ পর্নস্টাররা রােজগারের উদ্দেশ্যে স্বেচ্ছায় সেলুলয়েডে যৌনমিলন করেছেন। বিশ্বাস না-হয় Wikipedia দেখুন। রেড লাইট এরিয়ার বাসিন্দাদের সঙ্গে পর্নস্টারদের বেশ্যামির মূলগত পার্থক্য হল – রেড লাইট এরিয়ার বাসিন্দারা নির্ধরিত অর্থের বিনিময়ে রুদ্ধদ্বার কক্ষের ভিতরে খরিদ্দারদের সঙ্গে যৌনমিলন করেন, পর্নস্টাররা কোটি কোটি মানুষদের দেখানাের জন্য আর্থিক চুক্তিতে মুভি ক্যামেরার সামনে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রদর্শনসহ সহ যৌনাচার করেন। পর্নস্টাররা লিখিত চুক্তির মাধ্যমেই তাদের যৌনকর্ম সেলুলয়েড বন্দি করেন, রেড লাইট এরিয়ার বাসিন্দারা সম্পূর্ণ মৌখিক চুক্তিতে যৌনমিলন করেন।

(৫) সেলুলয়েডের বেশ্যা ঃ রাজকাপুর খুব কায়দা করে সেলুলয়েডে নারীর শরীর বিক্রি করেছেন। সেটাই সংশ্লিষ্ট ছবির জন্য সংশ্লিষ্ট নায়িকার প্রতি পরিচালকের মােলায়েম শর্ত। যেমন ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’ ছবিতে জিনাত, রাম তেরি গঙ্গা মৈলি’ ছবিতে মন্দাকিনী। এরপর নির্মাতাদের আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। গুটি গুটি পায়ে সেলুলয়েডের পর্দায় যৌনমিলনের দৃশ্যও ক্যামেরাবন্দি করার সাহস জুগিয়ে ফেলেছেন। সেইসব দৃশ্য সেন্সরের জ্যাঠামিতে (!) বাণিজ্যিক রিলিজ না হলেও ইন্টারনেট রিলিজ হতে কোনাে বাধা নেই। গা, মাশরুম (ছত্রাক), রঙ রসিয়া, কামসূত্র, কামসূত্র থ্রিডি, সিদ্ধার্থ, মচালতা জওয়ানি, রেশমি কি জওয়ানি, গােলাবি রাতে, হর রাত নই খিলাড়ি ইত্যাদি। গাণ্ডুর নায়িকা, ছত্রাকের নায়িকা, রঙ রসিয়ার নায়িকা, কামসুত্রের নায়িকাদের সাধারণ মানুষ ‘বেশ্যা’ বলেই অভিহিত করেন। এইসব মুভির নায়িকা-পরিচালকরা প্রায়ই একটা মজার কথা বলে থাকেন, তা হল – “চিত্রনাট্যের ডিম্যান্ড”। কী এই চিত্রনাট্যের ডিম্যান্ড”? কে বানায় এই চিত্রনাট্য ? কে ক্রিয়েট করেন ডিম্যান্ড? স্বর্গ থেকে কি আসে ডিম্যান্ড? ঈশ্বর-প্রেরিত? শিল্পের নামে বেশ্যামি ! সেন্সর ছাড়পত্র না দিলেও ওই যৌনমিলনের দৃশ্যগুলি টেক করা হয়। দৃশ্যগুলি যে সেন্সর ছাড়পত্র দেবেনা, দৃশ্যগুলি যে দিনের আলাের মুখ দেখবেনা – সেটা কি প্রযােজক, পরিচালক, অভিনেতা-অভিনেত্রীরা জানেন না? কোন ধনকুবেরদের জন্য এই সেলুলয়েড ভরতি যৌনমিলন? শুধু ভারতেই নয়, পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশেই সিনেমার নামে এক শ্রেণির অভিনেতা-অভিনেত্রীরা যৌনমিলনের দৃশ্য সেলুলয়েড-বন্দি করেন।‘গাণ্ডু’ও ‘কসমিক সেক্স মুভির অভিনেত্রী ঋ এক সাক্ষাৎকারে কী বলছেন শুনুন, “আমার শরীরের মালিকানা আমার। দোকান সাজিয়ে বসেছি। বেচতে লজ্জা কিসের! আমার বাবু আর দালাল আমি নিজেই। যারা আমার শরীর দেখে লজ্জা পান, উত্তেজিত হয়ে পড়েন, তাঁরা হােন। কিন্তু এই যে প্রতিনিয়ত তাদের আদিম সত্তাকে ‘ট্রিগার’ করি, এটাই কানেকশন উইথ মাই অডিয়েন্স’(সুত্র : http://eisamay.indiatimes.com/city/kolkata/an-interview-with-rii-and-parnomitra-about-tollygunge-nudity-by-starupa-basu/articleshow/ 45591512.cms)”।

(৬) শিল্পের ক্যানভাসে বেশ্যা : ‘রং রসিয়া’ মুভিতে দেখানাে হয়েছে চিত্রশিল্পী রবি। ভার্মার চিত্রশিল্পের মডেল সুগন্ধিকে, যিনি চিত্রশিল্পীর চিত্রশিল্পের জন্য নগ্ন হতেন এবং কখনাে-সখনাে চিত্রশিল্পীর সঙ্গে যৌনমিলনও করতেন। সুগন্ধি বিলক্ষণ বুঝেছিলেন তিনি শিল্প এবং প্রেমের জন্য নগ্ন হলেও রবি ভার্মা, রক্ষণশীল সমাজ, রাষ্ট্র তাকে ‘বেশ্যা’ হিসাবেই দেখত। স্বীকৃতিহীন এক নারী সুগন্ধির পরিণতি হল গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা। চিত্রশিল্পীরা ছবি আঁকবেন, ভাস্কররা ভাস্কর্য গড়বেন – এ তাে সুখের ব্যাপার। শিল্প মনের বিকাশ ঘটায়, চেতনার মুক্তি দেয়।

ঠিক কবে থেকে শিল্পীদের নগ্ন নারী প্রয়ােজন হয়েছিল তা ঠিকঠাক সাল-তারিখ জানা -গেলেও একথা বলাই যায়, পুরুষ-পরিচালিত পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় পুরুষরা নারীদের নগ্ন করতে নগ্ন দেখতে নানা অছিলায় লালায়িত ছিল। শুধু ছিল বলব কেন? আছে এবং থাকবে যতদিন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যস্থা থাকবে। নগ্নচর্চা শুরু হয়েছে সম্ভবত রাজাদের ইচ্ছাপূরণে শিল্পীদের নিয়ােগে। রাজারা নগ্নতা খুব পছন্দ করতেন। তারা আদিরসাত্মক কাহিনি পছন্দ করতেন বলেই প্রাচীন সাহিত্য রগরগে যৌনকাহিনিতে ভরপুর। রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, সংস্কৃত সাহিত্যে আদিরসাত্মক এতটাই যে, মূল ভাষার কাহিনি অপ্রাপ্তবয়স্ক পাঠ করা নিষিদ্ধই। শুধু অক্ষর-লেখনিতেই নয়, তুলিতে-ছেনিতেও নারীকে নগ্ন করার প্রয়াস শুরু হয়েছিল। সমালােচনার ঝড় এড়াতে মাহাত্ম্য জুড়ে দেওয়া হল শিল্পের নামে। শিল্প, তাই নারীকে যত খুশি নগ্ন করাে আর সামনে বসাও, শােয়াও এবং দাঁড় করাও।

(৭) দেবদাসী প্রথায় বেশ্যা ঃ দক্ষিণের তিরুপতি মন্দিরে দেবদাসী সংগ্রহের প্রাচীন পদ্ধতি সম্পর্কে খ্রিস্টান মিশনারি অ্যাবে জে এ দুর্ব এক সমীক্ষায় লিখেছেন, বছরের একটি বিশেষ দিনে এই মন্দিরের পুরােহিতরা ভগবান বেঙ্কটেশ্বরের প্রতিমূর্তি নিয়ে শােভাযাত্রা বের করতেন এবং পথে যত সুন্দরী মেয়ে দেখত তাদেরকে দেবদাসী করার দাবি জানাত। এমনকি শুধু কুমারী নয়, বিবাহিত মহিলাদেরও দাবি করত তারা। এ থেকেই বােঝা যায়, দেবদাসী করার জন্য অনেক মেয়েকে জোর করেই তুলে আনা হত। দুবার এহেন অনুধাবনযােগ্য।

শুধু ভারতেই নয়, বিশ্বের অনেক জায়গাতেই দেবদাসী ব্যবস্থা চালু ছিল। গবেষক পণ্ডিত জি জি ফ্রেজার পশ্চিম আফ্রিকায় দেবদাসী সংগ্রহের যে অভিনব উপায়ের উল্লেখ করেছিলেন তাতেও জানা যায় যে, মেয়েদের জোর করে তুলে এনে দেবদাসী বেশ্যা বা গণিকা বানানাে হত। ফ্রিজার লিখেছেন, পুরােহিতরা একটা বিশেষ দিনে নগরের পথে পথে ঘুরে বেড়াত দিনে এবং সেদিন দুয়ারের বাইরে যত কুমারী মেয়ে পেত তাদের সবাইকে ধরে নিয়ে যেত মন্দিরে দেবদাসী করার জন্য।

রাজ্য জয় করে রাজারা যেমন গােরু-ছাগলের মতাে মেয়েদের ধরে নিয়ে আসত, তেমনই সেইসব মেয়েদের ধরে ধরে এনে দেবদাসীও বানানাে হত। এভাবেই দেবতার বউ বানানাের ছলে মেয়ে তুলে এনে বেশ্যা বানানাে হত। ১৮৬৭-৬৮ সালে জন শর্ট লন্ডনের অ্যানথ্রোপলজিক্যাল সােসাইটিতে ভারতের দেবদাসীদের নিয়ে একটি রিপাের্ট পেশ করেন। রিপাের্টে বলা হয়েছে, মন্দিরের দেবদাসীদের কুমারীত্ব বহিরাগত ধনীদের কাছে বিক্রি হত। চড়া দামে। তারপর তারা বেশ্যাবৃত্তিকে জীবিকা হিসাবে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়।

দেবদাসীদের মােটামুটি ছয় ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন – (১) বিক্রিতা, (২) ভৃত্যা, (৩) ভক্তা, (৪) দত্ত, (৫) হৃতা এবং (৬) অলংকারা।

(১) বিক্রিতা ও অর্থের বিনিময়ে এদের কিনে নেওয়া হত। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এরা অত্যন্ত গরিব ঘরের সুন্দরী মেয়ে। একাধিক মেয়ের পিতা অর্থের বিনিময়ে এরকম দু-একটি মেয়েকে তুলে দিত পুরােহিতদের মালিকানায়। দেবদাসীদের গর্ভজাতা মেয়েও এই দলের অন্তর্ভুক্ত হয়। এইসব মেয়েরা যৌবনপ্রাপ্ত হলে মন্দিরের পুরােহিত নিজে অথবা তার প্রিয়পাত্রকে দিয়ে কৌমার্য খতম করে দেবদাসী পদে নিয়ােগ করত।

(২) ভৃত্যা ও বিশেষণ পড়েই বুঝতেই পারছেন এরা ভৃত্য, মানে ভত্যশ্রেণির। তাই স্বাভাবিকভাবেই এরা পদমর্যাদায় দেবদাসীর নিচে। যৌবনাদের কর্তব্য ছিল মন্দিরের অতিথিবর্গকে দেহদানের মাধ্যমে শরীরী-পরিসেবা দিতে হত।

(৩) ভক্তাঃ স্বেচ্ছায় কোনাে রমণী (কুমারী, সধবা, স্বামী পরিত্যক্তা) মন্দির কর্তৃপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণ করে যখন দেবদাসী হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন, তাহলে সে ভক্তা। ভক্তিই এঁদের আধার। এঁরা অতি উচ্চ সম্মানের পদাধিকারী। এদেরকে দেহদানে লিপ্ত হতে হত না।

(৪) দত্তা ও কোনাে ধর্মান্ধ পুণ্যলােভী পিতা মনবাসনা চরিতার্থ করার জন্য, মানত রাখার জন্য, স্বেচ্ছায় নিজের মেয়েকে মন্দিরে দান করলে সেই মেয়ে দত্ত হয়।

(৫) হৃতা এই মেয়েদের মুলত চুরি করে আনা হত। নিরদিষ্টার সন্ধান পেত না। সেই অঞ্চলের নগর-কোটাল। সেই মেয়ে বহু দূর দেশে মন্দিরের অন্ধকূপে বন্দিনী হিসাবে। থাকত।

(৬) অলংকারা ঃ যে-কোনাে শ্রেণির দেবদাসীই রূপ-গুণ নৃত্যগীত পারদর্শিতার বিচারে ওই শীর্ষপদে উন্নীত হতে পারে। ঐহিক বিচারে এই মেয়েরা শীর্ষস্থানীয় হলেও শ্রদ্ধা ও সম্মানের দিক থেকে ভক্ত শ্রেণির নিচে। | দেবদাসী প্রথা নির্মূল হয়ে গেছে বলে অনেকে নিশ্চিন্তের টেকুর তােলেন। না, সেঁকুর তুলবেন না। কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, মহারাষ্ট্রের কিছু মন্দিরে এখনও বিগ্রহের কাছে মেয়েদের বিসর্জন দেওয়া হয়। আজকের দেবদাসীরা আর দেবতার দাস নয়, তারা লােলুপ পুরষের লালসার শিকার। আর এই লালসা তৃপ্ত করতে এগিয়ে এসেছেন যেসব মন্দিরের রক্ষক, সেগুলির মধ্যে কর্ণাটকের ইয়েলাম্মা মন্দির। যেহেতু মন্দিরকন্যাদের বিয়ে হয় না, তাদের বিনা দ্বিধায় সম্ভোগ করেন সমাজের বিভিন্ন স্তরের পুরষেরা। যে পূজারী দেবদাসী অর্পণের কাজে লিপ্ত, তিনি মােটা অর্থ প্রাপ্ত হন। যাঁরা এই প্রথাকে তাদের জাতিগত ঐতিহ্যের অংশ মনে করেন, তাঁরা বড়ােই তৃপ্ত হন। তা ছাড়া ইয়েলাম্মা মন্দিরের মেয়েরা প্রকৃত অর্থে দেবদাসী নন। এঁরা না বােঝেন চৌষট্টি কলা, না কোনাে ধনীব্যাক্তির রক্ষিতা। একপ্রকার খােলাখুলিভাবেই দেহবিক্রিই তাদের কাজ।

মহারাষ্ট্র ও কর্ণাটকের প্রান্তিক জেলাগুলি থেকে প্রতি বছর প্রায় পাঁচ হাজার হরিজন। শ্রেণির মেয়েদের ইয়ালাম্মার কাছে অর্পণ করা হয়। এই প্রথার পিছনে শুধু বহু যুগের বিশ্বাস এবং অজ্ঞতা আছে তা নয় – আছে আর্থিক কারণ, আছে পুরােহিতদের প্ররােচনা। প্রাচীন প্রথার এই দুঃসহ আধুনিকীকরণ সব থেকে বেশি প্রচলিত কর্ণাটকের বেলগাঁও, ধারওয়ার, বিজাপুর, গুলবর্গা ও বেলারি জেলায়। অন্যদিকে মহারাষ্ট্রের সিতারা, কোলাপুর, শােলাপুর। ও ওসমানাবাদ অঞ্চলে এই প্রাচীন প্রথা প্রচলিত আছে। জানা গেছে, অন্ধ্রের নিজামাবাদ অঞ্চলে এবং তেলেঙ্গানাতে যথাক্রমে ১০ হাজার এবং ২৫ হাজার দেবদাসী আছে। বংশপরম্পরায় এই মেয়েরা পুরুষদের গ্রাস হয়েই থাকল।…………

………(৯) মধুচক্র ও শত শত আবাসিক হােটেলের ফ্ল্যাট এবং নির্জন বাড়ি এখন একেকটি | যৌনমক্তির লীলাভূমি হয়ে উঠেছে। এইসব স্থান নিষিদ্ধপল্লিগুলির চেয়ে অনেক বেশি সাফসুতরাে, সহজগম্য এবং অনেকটা ফ্রেস এবং ঘরােয়া পরিবেশ এবং গায়ে বেশ্যা বা বেশ্যালয় নামটি সাঁটা নেই বলে মেয়েরা এবং রসিকপুরুষরা বেশি পছন্দ করেন। | নিষিদ্ধপল্লিগুলির চেয়ে মধুচক্রগুলিতে রেস্ত অনেক গুণ বেশি গুণতে হলেও একটু পয়সাকড়ি যাদের পকেটে আছে তারা মধুচক্রই পছন্দ করছেন। তার উপর এখানে ক্রেতা এবং বিক্রেতা প্রায় সকলেই উঁচুতলার মানুষ হয়ে থাকেন। এখানকার শরীরবিক্রেতারা আসেন বিনিময়ে অর্থ নেন, কিন্তু নন। এরা সাধারণত পছন্দের পুরুষের সঙ্গে বা গ্রুপ সেক্স করেন। এন্টারচেঞ্জ (একে-অপরের স্বামী-স্ত্রী বদলাবদলা) সেক্সও সম্পন্ন হয়। এখানে তারাই আসেন যারা তাদের পছন্দের সঙ্গী বা সঙ্গিনীর সঙ্গে নিজের নিজের জায়গায় যৌনক্রিয়া সম্পাদন করতে বাধাপ্রাপ্ত হন। তবে এইসব পাত্রপাত্রীদের মধ্যে অর্থ লেনদেন না-হলে হােটেল বা ফ্ল্যাটের মালিক বা বাড়ির কর্তাকে অবশ্যই মােটা টাকার থাউকো ভাড়া দিতে হয়। সেই কারণে পতিতালয় ও রাস্তাঘাটের চেয়ে অনেক বেশি অর্থ খরচ করেও যৌনপরিসেবা ক্রয়ের জন্য শহরের আবাসিক হােটেলসমূহে ২৪ ঘন্টা ধরেই কী ভয়ানক চাপ পড়ে তা হঠাৎ পরিচালিত পুলিশ রেইডে ধরা পড়া নারী ও পুরুষদের সংখ্যার দিকে তাকালেই অনুমান করা যায়। আর ফ্ল্যাটবাড়ির আশ্রয়ে পরিচালিত হওয়া যৌনব্যাবসার চিত্রটি আমাদের কাছে আড়ালেই থেকে যায়, থেকে যাচ্ছে, থেকে যাবে। এইসব নারী এবং পুরুষদের গায়ে ‘বেশ্যা’ লেবেল না-থাকায় সমাজে বুক ফুলিয়ে চলতে কোনাে অসুবিধা নেই। প্রতিবেশীদের কাছ থেকে অভিযােগ না-উঠলে কিংবা ওসব স্পটে কেউ খুন না-হলে সাধারণত সেগুলি আইনপ্রয়ােগকারী সংস্থা এবং গণমাধ্যমের আড়ালেই থাকে। উল্লেখ্য, এসব স্পট, স্পটের কর্তা এবং স্পটের গ্রাহকরা প্রায়শই হন উচ্চমধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তেরা এবং হােমড়া-চোমড়া দুনিয়ার। সেই কারণে ঘটনার কথা জেনেও কেউ আগ বাড়িয়ে কাঠি দিতে যায় না। সম্প্রতি জানা গেছে, মুম্বাইয়ে নামজাদা। এক চলচ্চিত্র অভিনেত্রীর নিজ দেওয়া ফ্ল্যাটে মধুচক্র চলত। সংশ্লিষ্ট অভিনেত্রী মধুচক্র পরিচালনা করতেন কিনা তা যথাযথ জানা যাবে বলে মনে হয় না। কিছুদিন আগে হায়দ্রাবাদের বানজারা হিলসের একটি বিলাসবহুল হােটেলে মধুচক্র থেকে শ্বেতা (শ্বেতা বসু প্রসাদ) নামে এক মুম্বাইয়ের প্রাক্তন অভিনেত্রীকে হাতেনাতে ধরে ফেলা হয়। এই রাতে তার রেট ছিল ৫ লাখ, ১ লাখ টাকা অগ্রিমও পেয়ে গিয়েছিল। গ্ল্যামার জগতের খ্যাতির ছোঁয়া পেয়ে অভিনেত্রীদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা বেড়ে যায়। চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়! অন্য পেশার মতাে অভিনেত্রীদেরও সবসময় সুদিন থাকে না। দু-হাতে সমানে ডলার ঘাটতে ঘাটতে যখন কেউ | কেউ সুদিন হারাতে থাকে তখনই এসে যায় শরীর-ব্যবসার মতাে লাভজনক ব্যাবসার হাতছানি। ইচ্ছায়, অনিচ্ছায় এবং আম-ইচ্ছায় এই গােপন লীলায় সঁপে দেন নিজেদের। সেলিব্রেটি হওয়ার সুবাদে শরীর-মূলও অনেক চড়া হয়। শুধু শ্বেতা নয়, এর আগেও বেশ কয়েকজন | অভিনেত্রীর বিরুদ্ধে দেহব্যাবসার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযােগ উঠেছে। এরা হলেন ঐশ আনসারি, ভুবনেশ্বরী, সায়রাবানু, শ্রাবণী, যমুনা, দিব্যাশ্রী প্রমুখ। ২০০৯ সালে তামিল সিনেমার সুপারস্টার ভুবনেশ্বরী গ্রেফতার হয়েছিলেন, ইনি নিজের মােহময়ী রূপকে কাজে লাগিয়ে খরিদ্দার ধরতেন শুধু তা নয় – গ্ল্যামার জগতে উঠতি তারকাদের নিজের ফ্ল্যাটে নিয়ে এসে | যৌনকর্ম করতেন। শােনা যায়, ভুবনেশ্বরী নীল ছবির অভিনয়েও যুক্ত ছিলেন। ২০১৩ সালে যযাধপুরের একটি হােটেল থেকে আপত্তিকর অবস্থায় হাতেনাতে ধরা পড়েছিলেন অভিনেত্রী ঐশ আনসারি। ২০১৩ সালেই আর-এক তামিল অভিনেত্রী সায়রাবানুও গ্রেফতার হন দেহব্যাবসায় জড়িত থাকার অভিযােগে। দক্ষিণী ছবির আরও দুইজন অভিনেত্রী শ্রাবণী এবং যমুনাকে মধুচক্র চালালাের অভিযােগে গ্রেফতার করা হয়। শ্বেতার গ্রেফতারের পর মিডিয়া যখন তােলপাড় শুরু করে দিল তখন আর-এক বলিউডের প্রখ্যাত অভিনেত্রী শ্বেতাদের হয়ে জোরদার সওয়াল করলেন। বললেন, “শ্বেতাকে দোষের ভাগীদার বানানাে হচ্ছে। তার দিকে আঙুল তােলা হচ্ছে। অথচ তার বিত্তশালী খরিদ্দারদের নাম আড়াল করে যাচ্ছে পুলিশ। শ্বেতার পাশাপাশি ওইসব লােকগুলির নামও সামনে আসা উচিত। তাদের ঘরের মা-বােন-মেয়েরা জানুক তাদের ঘরের পুরুষ কত বিচিত্র চরিত্র”। পুলিশ চুপসে গেল, মিডিয়া হড়কে গেল। ২০১৩ সালে পুলিশ এবং মিডিয়ার এমনই পরিস্থিতি হয়েছিল শ্রাবণীকে গ্রেফতার করার পর। জানা যায়, শ্রাবণীর খরিদ্দারদের বেশিরভাগই হল অন্ধ্রপ্রদেশের কয়েকজন মন্ত্রী। এটা জানার পরই পুলিশ ও মিডিয়ারারণে ভঙ্গ দেয়। পরে অবশ্য হায়দ্রাবাদের নামপল্লির মেট্রোপলিটন দায়রা আদালত শ্বেতাকে ক্লিনচিট দেওয়া হয়েছে বলে খবরে প্রকাশ হয়েছে। তাই বলে কি শ্বেতার কলঙ্ক ঘুচল!……………


Tags: , , , ,

Comments are closed here.