নিলক্ষার চর – আল মাহমুদ (৮ম পর্ব শেষ)

December 11, 2020 | By Admin | Filed in: বিখ্যাত লেখকদের সাহিত্যে যৌনতা.

মইষা বেণী খুলে পানিতে ভাসিয়ে নাড়ল। তারপর আরও একটা বৃহৎ ডুব দিয়ে করজোড়ে ঢেউয়ের ওপর ভেসে মৃদু শব্দে বলল, কৃষ্ণ, কৃষ্ণ! আজ বেশ দেরি করেই তােরাব বাথানের বিছানা ছেড়ে নিচে নেমে এল। কালা আর কামাল প্রতিদিনের মতাে চারণভূমির দূর দূর এলাকায় চলে গেছে। তােরাব বাইরে এসে দেখল প্রচুর কলমি শাকের বােঝা মাথায় নিয়ে শাকঝাড়া পানি নিংড়ে ফেলতে ফেলতে মইষা চামারনি আঘাটা থেকে ছাউনির সীমানায় এসে দাঁড়িয়েছে। সামনে তােরাবকে দেখে মইষা হাসল। আইজ মনে হয় সর্দারের নিয়ম ভাইঙ্গা গেল। হুনছি রাইত থাকতে তুমি সব কাজ সার। রাইত থাকতে গরু লইয়া চড়াইতে যাও। আইজ কী তােরাব রাজার শরীর ভালা না?

ভালাই। তয় আইজ যাই নাই। ওই দুইটা গােলাইম্যারে গাই গরু সামলাইতে দিছি। আসছে মইষা বিবি তােমার সাথে একদিনও ভালা কইরা কথা অইল না। বুঝ তো, ওই হারামজাদার খাবলাখাবলিতে কোসা নাওয়ের কান্দে বসাইয়া তােমারে লইয়া আইছি। নাইলে ওই কুত্তার বাইচ্চারা আমারে একদিন পাজনের বাড়িতে খুন কইরা ফালাইত। তুমি তাে জান না মানুষের রূপ ধইরা দুইডা শয়তান আমার দুই বাজুতে চলাচল করে। কানাকানি করে। কী কমু আর। আইজ তােমার লাইগ্যা থাকলাম। এই প্রথম তােরাব সর্দার মইষাকে তুই থেকে তুমিতে সম্বােধন করল । গলাটা বেশ নামানাে, মায়া ভরা। মইষা তােরাবের গলা শুনেই বুঝল, একটা দেওয়ের ভেতর থেকে যেন মানুষের গলা বার অইতাছে। মইষা মাথা থেকে কলমিগুলাে সরিয়ে ফেলল। ভেজা বুক দুটো অর্ধসিক্ত শাড়িতেই আবৃত করে শরমিন্দা হয়ে হেসে বলল, টোপায় রাখা এক কলস কাঁচা দুধ জ্বাল দিয়া আনুম সর্দার? ছাউনির ভিতরে বইবা? তুমি চুলার পাড় যাও। আমার কাছে চায়ের পাতা লুকানাে আছে। মাঝে মাঝে খাই। আমি। দেকি আছে কি না। কাইল্যা চোরা পাতি পাতি কইরা খুঁজে কী না। ওই হারামজাদা যতক্ষণ এইখানে থাকে খালি খুঁজে। হুদা চা পাতা না, ও যে কী খুঁজে সেইটা ওর মা কালীই জানে। কইছি না দুইটাই হইল ইবলিসের পেশাবখাের। নেশা পাইলে আর ছাড়ে না। আমি দুধ চুরি কইরা হেরার লাইগ্যা তামুক যােগাই, মায়া মানুষ যােগাই, মরা গরুর চামড়া ছাড়াইয়া বেচি। কী করুম কও! মানুষ কয় নিলইক্ষ্যার চরে নাকি আইন কানুন নেই। কেমনে থাকব এইডাও জেলখানা। সাস্ত্রী সিপাই ছাড়া জেলখানা। উত্তর দিক থিক্যা আগাইয়া আইতাছে পােড়া ইট, ইটের চুল্লি আর গরুর ঘাসের জমি পিছাইয়া যাইতাছে। ইট সব খাইয়া ফেলব। ছােড অইয়া আইতাছে। কমতে কমতে একদিন পােড়া ইটই থাকব। মানুষ, গরু থাকব না। বুঝলা মইষা বিবি। সবুজ থাকব না, ঘাস গজাইব না। বলতে বলতে মইষার চেহারার দিকে উদাসীনভাবে দৃষ্টিপাত করে দাঁড়িয়ে রইল তােরাব সর্দার। মনে হয় তার দৃষ্টিতে কোন কিছুর প্রতিফলন নেই। এক দুর্বহ পরিণতির ছবি যেন সে মইষার চেহারার দিকে তাকিয়ে দেখতে পাচ্ছে। মইষা ভেজা আঁচলটা একটু টেনেটুনে প্রসারিত করে বুক ঘিরে মাথার উপর তুলল। আমি গিয়ে চুলায় ফুঁ দেই। তুমি আইয়। এ কথায় তােরাব আবার পেছন ফিরে বাথানের ভেতরে চলে গেল।

মইষা ভেজা সায়াটা মুচড়ে পানি নিংড়ে একটা বাঁশের উপর ঝুলিয়ে দিয়ে কলমি শাকের বােঝাটা বেড়ার এক পাশে সরিয়ে রেখে চুলার পাড়ে একটা ছিদ্রযুক্ত বাঁশের চোঙা নিয়ে চুলার ভেতরে ফু দিতে লাগল। একটা ফুতেই ছাইয়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল কাঠের জেতা আগুন। শাল কাঠের লাকড়ি ইটখলা থেকে সংগ্রহ করে আনে কামাল আর কালা। চুলাটা জ্বলে দিন রাত। এই চুলার আগুন ছাড়া খলার রাজত্বে আর কোন সভ্যতা নেই। থাকার দরকারও নেই। আগুন আছে আর তিতাসের পানি যতক্ষণ বহমান আছে ততক্ষণ এরা নিশ্চিন্ত। মইষা নানাভাবে চোঙ্গার ফু, কাঠের টুকরা ও নানা তুকতাক করে আগুনের শিখা বের করে আনল। ফট ফট শব্দ হচ্ছে চুলা থেকে। বাঁকা কাঠের গিট খােলার শব্দ। মইষা মাটির হাঁড়িতে দুধ চড়িয়ে দিল। এর মধ্যেই তার বুকের আঁচল আগুনের আঁচে শুকিয়ে গেছে। ঘামের বিন্দু দেখা দিয়েছে কপালে। মইষার গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের হলেও চেহারাটা তামাটে। এর উপর আগুনের আঁচ পড়ায় ঘামে, গন্ধে তাকে মনে হচ্ছে পােড়া ইটের মতাে। রক্তবর্ণা । এ সময় একটা ছােট মুখ বন্ধ ডিবা নিয়ে সেখানে হাজির হলাে তােরাব সর্দার। লও। এতে চায়ের গুঁড়া আছে। মইষা ডিবাটা হাতে নিল। তােরাব মুখ তুলে মইষার ঘর্মাক্ত লাল মুখের দিকে একবার দেখল। তুমি তাে খুব সুন্দর দেখতে! এ কথায় মইষা মুচকি হাসল। যাই হােক সর্দারের চোখ পড়েছে। চামারনির রূপ দেইখ্যা খুশি অইছে রাকখালের রাজা। তুমি খুব সুন্দর। অত তােয়াজ করতে অইব না। আমি তাে সব সময় উপাইস্যা মাইনষের ভুখ মিটাইবার জন্য বইয়াই থাকি। বলে খিলখিল করে হেসে উঠল মইষা । হাসতে হাসতে কাত হয়ে পড়ল এক দিকে। হাত বাড়িয়ে তােরাব মইষার একটি নগ্ন বাহু ধরে ফেলল। আমার সাথে বিয়া বইবা? ও মা কয় কী? আমি তাে চামারনি ঋষি, ছােড জাত। তুই আগুনের মতাে সুন্দর আর পানির মতাে ঠান্ডা । আমি তরে লইয়া খলা ছাইড়া পলামু ।

রাকবালি ছাইড়া মাঝি অইয়া বাঁচুম। আমার এক মুই আছে গােকনঘাটে। তার জামাই কলের নৌকা চালায়। তরে লইয়া হিয়ানে যামুগ। আমিও চামার, চামারের অধম, তুই রাজি অইয়া যা। মইষা আস্তে বলল, আমার হাতটা ছাড় সর্দার। তােমার আঙুল তাে লােয়ার মতাে শক্ত। একটু ছাড়। তােরাব হাতটা ছেড়ে দিয়ে বলল, আমারে পছন্দ অয় না তর? এইখানে পছন্দ অপছন্দের কথা নাই সর্দার। আমি বহু মাইনষের ঘাঁটা ময়লা, কাদা, আগুন না যেমন তুমি দেখতাছ। আমার মতাে মাগিরে কেউ বিশ্বাস করে না। তুমিও করবা না! শখ মিট্যা গেলে আবার গতর থিক্যা পচা মাটির গন্ধ বাইরব। খাবলাইন্যা মাটির গন্ধ। কুলটা চামারনি কোনদিন বউ অয় না। নেও দুধের উপর বগলাইয়া সর উঠতাছে। হাতা দিয়ে তুইল্যা দেই ধাও। আমারেও খাও। বউ বানাইবার কথা কইয় না। আমি বউ অইবার খােয়াব দেখি না। বুঝলাম এইখান থিক্যা আমার ভাত উঠছে। আজ আমারে খাও। কাইল বিয়ানে আমি চইলা যামু। মইষার কথায়, প্রত্যাখ্যানে তােরাবের মনে হলাে তার বিশাল ছাতির উপর একটা মায়া মানুষ যেন জোরে লাথি মারছে। সে স্তম্ভিত ও দিশাহারা হয়ে মইষার মাটির হাতায় সর নিংড়ানাের কৌশলটা দেখতে লাগল। ধোঁয়াউড়া সরের হাতাটা মইষা এগিয়ে দিল তােরাবের দিকে। নেও সর্দার। ফু দাও, ঠান্ডা অইয়া যাইব। চামড়ার মতাে অইয়া যাইব। খাও আর আমারে দেখ । আমি চিৎ অইবার লাইগ্যা বইয়া থাকলাম। আবার খিলখিল হাসির শব্দ। গরম সরের ওপর ফু দিতে দিতে তােরাব সর্দার মন্ত্র উচ্চারণ করার মতাে কইল, তরে লইয়া ঘর বান্দুম, পলামু। এই খলা, এই ঘাসের চর, গরু বাছুর সব ফালাইয়া যামুগা। তুই রাজি অইয়া যা। মইষা বিবি, আমি তরে ভালােবাসি। মনে অয় তুমি আমারে রাইত পর্যন্ত থাকবার দিবা না। হুন সর্দার, আমি ছােড জাতের মায়া। চামার মেথরের সুন্দরী বুউঝিরে কেউ কয় না ভালােবাসি। খালি চিৎ কইরা ফালাইয়া রস ঝরাইয়া পলাইয়া যায়। এই আমি জীবনের পরথম হুনলাম কেউ আমারে বউ বানাইতে চায়। বলতে বলতে প্রথমে হাসি ও পরে হু হু করে কেঁদে মইষা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। হাতাটা আবার দুধের পাতিলে ঘুরিয়ে ডুবিয়ে দিল তােরাব সর্দার। তারপর মইষাকে মাটি থেকে বুকের ওপর তুলে নিয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করতে লাগল। বিশ্বাস কর, তর থেইক্যা ভালা মায়া, খুবসুরত আওরত আমি আর দেখি নাই ।

এই কথায় মইষা দারুণ ফুপানি তুলে সর্দারের বুকের ওপর মাটির ঢেলার মতাে মিশে যেতে যেতে হাঁপাতে লাগল। আমারে ছাইড়া দেও সর্দার। আমি আর হাইনজা বেলার লাইগ্যা বইয়া থাকুম না। আমি চইলা যামু। আইজ পর্যন্ত আমারে কেউ কয় নাই কোন ভালবাসার কথা। এই কথাটাকু লইয়া যাইতে পারলে বুঝুম আমার ইষ্ট দেবতা রাধা মাধবের সারাজীবন জপ করা আমার বেৰ্থা যায় নাই। আমারে ছাইড়া দেও। আঘাটায় নিয়া আমারে একটা নাওয়ে তুইল্যা দেও। আমি দত্তখােলায় পানি দেই। তুমি তাে মায়া মানুষ বহুত পাইবা। কিন্তু আমার জন্য তুমি শেষ। খদার দোহাই এইটুকু লইয়া যাইবার সুযােগ আমারে দেও। সহসা বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতাে সর্দার মইষাকে বাহুর বন্ধন থেকে আলগা করে দিল। মইষা উঠে দাঁড়িয়েই আবার মাটিতে লুটিয়ে সর্দারকে প্রণাম করে বলল, আমি তইলে যাই। বলতে বলতে কোনদিকে না তাকিয়ে মইষা ছাউনির বাইরে চলে এল। হাঁটা শুরু করল আঘাটার দিকে। অনেক দূর চলে যাওয়ার পর তােরাব সর্দারও উঠে দাঁড়াল এবং এক পা এক পা করে আঘাটার দিকে হাঁটা দিল। তার চোখ থেকে উপচে বেরিয়ে এল এক জোড়া তিতাস নদী।


Tags: , , , , , ,

Comments are closed here.