নিলক্ষার চর – আল মাহমুদ (৬ষ্ঠ পর্ব)

December 9, 2020 | By Admin | Filed in: বিখ্যাত লেখকদের সাহিত্যে যৌনতা.

আমারে গলাইতে চাস? হুন আমি বেজন্মা না। আমার মা আমারে লইয়া বিধবা হইছিল। দুইটা গাই পালত। দুধ বেইচ্যা আমারে পাঠশালায় ভর্তি করছিল। আমি লেখাপড়া কিছু জানি। নাম লিখতে পারি, পড়তে পারি। বুঝলে মাগি । আমি গরু না । তুইত আমারে ষাড় ভাবছস। আমি গরু না, মানুষ। আদম। তবে কপালডা ভাইঙ্গা গেছে। এই যে বাথান দেখছস এর মালিক আমার মারে হাঙ্গার লােভ দেখাইয়া ওই দুইটা গাইসহ তার নিজের গােয়ালে লইয়া গেল। আমার মারে অবশ্য কাবিন কইরাই নিছল। মানুষটা একেবারে খারাপ ছিল না। আমারেও আদর করত। কিন্তু আমার কপাল ভাইঙ্গা গেল আমার মা বাচল না। এক বছরের মাথাতেই কলেরায় মইরা গেল। তয় ওই বাথানের মালিক আরব আলী আমারে কইল, দেখ তর মারে আমি বিয়া করছিলাম, আমার বউ ছিল আমি দুইটা গাইয়ের লােভে নিকা করি নাই। তরে আমি আমার নিজের পােলার মতাে আদর করছি। তর বয়স কত অইব বার-তেরাে। তুই যদি ইচ্ছা করস ওই দুইটা গাইসহ আরও দুইটা গাই বেশি দিয়া আমি বিদায় করতে চাই। আর যদি থাকতে চাস আমার সাথে তইলে তুই বাথানে চইলা যা। ওই নিলইক্ষার চরে আমার বাথান আছে, দেড়শ গাই গরু আছে। হিয়ানে গিয়া সর্দারি কর। যাবি? আমি কইলাম যামু। তারপর থেইকা এইখানে আছি। গরু-বাছুর তাে আমি পালতে পারি । এই একশ দেড়শ গাই গরু আমার কাছে কিছু না। আমি একটা আস্ত ষাঁড় কান্দে লইয়া ঘুরতে পারি। কিন্তু বিপদ অইছে দুই হারামজাদারে লইয়া। দুইটাই বেজন্মা, বাপ-মার ঠিক নাই। চোর, ডাকাইত, বদমাইশ। তবে আনছি এই দুইডারে দেখভাল করতে। আর নাইলেত এই দুইডা গাইয়ের উপরে গিয়া উঠব। তুই যদি এই দুইটারে সামাল দিতে পারস তাইলে বুঝবি এই নিলইক্ষার চরের রাজত্ব তর। নে এইবার ঘাডে গিয়া দুইডা ডুব দিয়া আয়। আমি গেলামগা। খাড়াও। ডাবাটা একটা টান দিয়া যাও । বলতে বলতে মইষা কল্কিতে তামাক সেজে একটা অঙ্গার চুলা থেকে তুলে বুড়াে আঙুল দিয়ে চাপ দিলাে। তারপর ডাবাটা এগিয়ে দিলাে তােরাবের দিকে। তােরাব মুগ্ধ হয়ে মইষাকে এই প্রথম ভালাে করে দেখল। তুই বড় ভালাে মায়া। সব মায়াই ভালা। কোন মায়ার ভেতরটা তুমি দেখছ? টানাে, আমি উঠলাম। আঘাড়ায় গিয়া ডুব দিমু আর পাশে যে কলমির ঝাড় সেইখানে থেইক্যা কলমি হাগ তুলুম। রাইতে কলমি হাগ খাইবা। বলে পাছায় একটু দুলুনি বাঁকিয়ে মইষা উঠে দাঁড়াল। তারপর কোন দিকে না তাকিয়ে সােজা হাঁটতে লাগল নদীর ঘাটের দিকে। তােরাব ভাবল, আহা চামার হউক, মেথর হউক মায়াড়ার একটা মাত্র শাড়ি। গতরে পেঁচাইবার আর তাে কিছু নাই। নাহ্, তর জন্য চুরি করতে অইব চামারনি। ডাকা ডালতে অইব।

মইষা আঘাটায় গিয়ে নদীর দিকে তাদিয়ে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর সােজা ঝাপিয়ে পড়ল নদীতে। সাঁতরে চলে এল কলমির দামের কাছে। এখানে নদীতে থৈ নেই। মইষা কলমির দাম আঁকড়ে ধরে পানির ভেতর পা ঠেলে অদ্ভুতভাবে ভেসে থাকল। এক হাতে কলমির কচি ডগা ভাঙতে গিয়ে দেখল ভাঙছে না মচকে যাচ্ছে। মইষা দাঁত দিয়ে কলমিডগা ছিড়ে কিছুক্ষণের মধ্যে স্তুপ করে ফেলল । মইষার নাড়াচাড়ায় কলমির দাম থেকে উড়ে পালাল কয়েকটা ডাহুকি। এ সময় ইঞ্জিনচালিত একটা নৌকা কোথেকে যেন মাঝ নদী ছেড়ে কলমির দামের কাছ দিয়ে এগিয়ে এল। মইষা দেখল মাঝিটা তার দিকে লােভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নাওটা খুব কাছে এসে পড়েছে। কী দেখ মাঝি? ল্যাংটা মেয়েলােক দেখ? মাঝিটা এই প্রশ্নে হকচকিয়ে গেল। এখন ইঞ্জিনটা বন্ধ করে দিয়ে সে মইষাকে অবাক বিস্ময়ে দেখছে। এই বেডি তুমি এই নিলইক্ষ্যার চরে থাক? তােমার হেই দিয়া কাম কী? আমার ঠিকানা জানতে চাও, হাঙ্গার প্রস্তাব দিবা? এই বেডি এমন কইরা কথা কও কেরে? কমুনা, তুমি আমার দিকে হা কইরা তাকাইয়া আছ। দেখ না আমার আব্রু নাই? ভালা চাওতাে চইলা যাও। আমার নাওয়ে উঠবা? তােমারে ঘুরাইয়া আনি। দেখ হারামজাদা! মায়া মানুষের বুঝিন দেখস নাই আগে? হা কইরা আছস। খাবি? মইষা তার ডান স্তনটি উঁচু করে দেখাল। লােকটা এ কথায় আবার ইঞ্জিন চালু করল। আমি ইচ্ছা করলে বেডি তরে জোর কইরা ধইরা লইয়া যাইতে পারি। জানস আমি কে? হারামজাদা তুই জানস আমি কে? আমি মইষা ঋষি। এই চরের রাকখাল সর্দার তােরাইব্যার ভাত রান্দি। এই কথা শুনেই মাঝিটা নির্বাক হয়ে গেল। সে দ্রুত নাওয়ের মুখ ঘুরিয়ে বিপরীত দিকে ধাওয়া করে পালিয়ে গেল। কলমির শাক নিয়ে মইষা ধীরে সুস্থে আঘাটার উঁচু পাড়ে রাখা একটা তক্তার উপর উঠে দাঁড়াল। তারপর ধীরে সুস্থে শাড়ির আঁচল চিপে পানি ঝরিয়ে আঁচলের বাড়িতে চুল ঝাড়তে লাগল। সূর্য তখন পশ্চিমে একটু ঢলে পড়েছে। মইষা ছাউনিতে ঢুকবার আগে শাড়িটা খুলে সম্পূর্ণ ন্যাংটো হয়ে গেল। তারপর শাড়ি ও ব্লাউজ ছাউনির তরজার উপর বিছিয়ে দিয়ে চুলার পাশে রাখা ভাত ও ব্যঞ্জন একত্র করে ক্ষুধার্ত ছাগির মতাে খেতে শুরু করল। খাওয়া শেষ হলে সােজা এসে আড়াশের উপর ভিজা চুল মেলে দিয়ে বালিশহীন বিছানায় কাত হয়ে ঘুমুতে লাগল।

সূর্য ডােবার একটু পরে ষাড়ের হাম্বা রব, নিশ্বাস, মানুষের হাঁকডাক ও তােরাবের কুৎসিত গালিগালাজের মধ্যে মইষা উঠে একটা গামছা দিয়ে ছতর ঢাকল । সহসা বাইরে গিয়ে শুকনাে শাড়ি ও সায়াটা এনে পরার ইচ্ছা থাকলেও বাইরে তােরাবের গলা শুনে সে গামছাটা কোমরে পেঁচিয়ে বুকের উপর টেনে ধরল । এ অবস্থায় মইষা চলে গেল ছাউনির বিপরীত দিকে। ভাবল বাথানে গরুগুলাে ঠিক মতাে ঢুকানাে পর্যন্ত সে এখান থেকে নড়বে না। কিন্তু গাই গরুর পানি খাওয়ার জায়গা এটা। এখানে অনেকগুলাে গামলা রাখা আছে। মইষা অবশ্য একটা গামলার আড়ালেই বসে পড়ল। এ সময় দুটি দামড়ি ও কয়েকটা বাছুর নিয়ে কালাকে আসতে দেখে মইষা গামলাটার পেছনে গুটিশুটি হয়ে বসে পড়ল। কালা দূর থেকে মইষার মাথা লক্ষ্য করে হাসল। ওই খানে লুকাইয়া আছ কেন? আমি লেংটা! তুই ছাউনির উপর থেইকা আমার শাড়িটা আইনা দে। বাছুরগুলাে ততক্ষণে গামলায় মুখ নামিয়ে দিয়েছে। কালা দ্রুত দৌড়ে ছাউনির চালা থেকে মইষার শাড়িটা নিয়ে এল। দেও। হাত বাড়াল মইষা। বাছুরগুলাের আড়ালে ছতর লুকিয়ে। কালীচরণ শাড়িটা এগিয়ে দিতে দিতে হাসল। তুমি তাে কথায় কথায় কৃষ্ণ কৃষ্ণ জপ কর। আজ দেখ তােমার সেই রাধা মাধবের। মতাে তােমারে শাড়ি আগাইয়া দিলাম। ওরে আমার ননী চোরারে! শাড়ি জড়িয়ে মইষা গামলা ও বাছুরের আড়াল থেকে সােজা হয়ে দাঁড়াল। এই সময় একটা পাজন হাতে কামাল এসে বলল, রাইতের রান্দায় আমি তােমারে যােগান দিমু। আমাদের তােরাব মিয়ার হুকুম। ছাউনিতে আলু আছে। আলু ভর্তা ঘি দিয়া ভাল্লাগব । কিন্তু আমাদের ঘি নাই। জ্বাল দিতে পারি না। তয় সর দিয়া মাখাইয়া খামু। এই বেডা খালি খাম খাম করে। আইজ তাে আমার পালা। কামাল গলার সুর নামিয়ে তার পালার কথা উচ্চারণ করলেই মইষা খিলখিল করে হেসে ফেলল। সবারই পালা আছে, তােরাইব্যার নাই? কামাল বলল, হেই দিকে হাত বাড়াইও না। আইজ পূর্ণিমার চান উঠব আসমানে। আমারে কান্দে লইয়া চরের শেষ মাথা পর্যন্ত যাইতে অইব।

এই কথা বেশি কইও না। জানি না তােরাইব্যার মতাে মানুষরে তুই কী দিয়া ভুলাইছস। আইজ গরু চরাইবার সময় তােরাব সর্দার তাের কথা কইল । বলল, মায়াডা বড় ভালা। কীরে কালা কয় নাই? এ কথায় দপ করে নিভে গেল মইষা ঋষির গলা। তােরাব সর্দার আমারে ভালা কইছে? এই লােকটা ত একটা পাথর। হায় রাধামাধব। ওই পাষাণডারে গলাইয়া দাও। মনে মনে প্রার্থনা করল মইষা ঋষি। কিন্তু মুখে বলল, কৃষ্ণ, কৃষ্ণ! হাত জোড় করে আকাশের দিকে নমস্কার করল। কামাল আতঙ্কিত গলায় বলল, সর্বনাশ! আইজ তরে লইয়া চাদনির চরে যাইতে সর্দার বাধা দিলে আমি মইরা যামু। তােরাব ততক্ষণে প্রায় পঁচিশটা ষাঁড়কে বাথানের বেড়ার ভেতর নির্দিষ্ট জায়গায় বেঁধে রেখে এল। কচুরিপানার ঝুড়ি এনে ষাঁড়গুলাের সামনে রেখে তাকিয়ে দেখল কামাল ও কালীচরণ অন্যান্য বাছুর ও গাই গরুকে তাদের জায়গা মতাে পৌছে দিয়ে পানি ও কটা শুকনাে বনের ঝুড়ি সাজিয়ে দিচ্ছে। গেইটের কাছে দুধের কয়েকটা কাইরা পড়ে আছে। এই কাইরাগুলাে শেষ রাতে এসে দুধে ভর্তি করে তােরাব ও শহর থেকে আসা বাথানের মালিকের লােকজন। এরা নিশাচরের মতাে আসে নিশচারের মতােই চলে যায়। বাথানের অন্য মানুষের সাথে বাথানের মালিকের লােকেরা কথা বলে না। কথা বলে শুধু সর্দার তােরাবের সাথে। তােরাবকে তারা টাকাপয়সা দুধ লেনদেনের খাতা সই করে ফিরিয়ে দেয়। বাথানের দেশনের ব্যাপারে তােরবই সর্বেসর্বা, স্বাধীন। তােরাবের বিরুদ্ধে বাথান, খলা ও ইটখলায় কারাে কোন নালিশ নেই। সবাই বলে লােকটা গোঁয়ার হলেও তার মধ্যে ইনসাফ আছে। সন্ধ্যায় বাথানের কাজ শেষ হলে কালীচরণ ও কামাল এসে রান্নার কাজে মইষাকে এটা সেটা এগিয়ে দিতে লাগল। কিন্তু মইষার দৃষ্টি বাথানের দিকে। তােরাব এখনও বাথানের গেইট পেরিয়ে ছাউনির দিকে আসেনি। কামাল এর মধ্যে মইষাকে প্রলুব্ধ করার জন্য কয়েকবার চেষ্টা করেছে। তার মুখেও ওই একই কথা। বুঝলা মইষা বিবি? আইজ আমার পালা। ওইরে হারামজাদা! তাের পেটের জ্বালার চেয়ে চেটের জ্বালা বেশি। এখন যদি তর মনিব আইয়া আমারে চুলে ধইরা টাইন্যা লইয়া যায় ময়দানে তখন তুই কী করবি? তােমার মুখে শুধু আকথা। আমার মনিবের ইনসাফ আছে। তরে আমরা সবাই ভাগ কইরা খামু। এর লাইগ্যাইতাে তরে আনছি। আগে কালা তরে ঘটছে। আইজ রাইত আমার ।এর মইধ্যে কে বাগড়া দিব? কামালের এই প্রতিক্রিয়ার সাথে সাথেই দানবের ছায়ার মতাে একটি বৃহৎ ছায়া এসে দাঁড়াল তিনজনের পেছনে।


Tags: , , , ,

Comments are closed here.