হালাল আওরত – আবুল বাশার

October 1, 2022 | By Admin | Filed in: পরোকিয়া.

একটি মানুষ দু’ভাবে জটিল হতে পারে। এক, সে চরিত্রে জটিল আর সে জটিল মেধাসম্পন্ন জটিল বলে। জটিল জটিল অঙ্ক বা হিসেব বা জটিলতর সমস্যা নিয়ে সক্রিয়, দুরূহ ত্রানসম্পন্ন জটিল।। চবিত্রে সবল, জ্ঞানে বা প্রতিভায় জটিল | এমন মানুষ সংসারে দেখা যায়।
আবার উল্টোটাও দেখা যায়। চরিত্রে জটিল, জ্ঞানে বা বুদ্ধিতে বা মেধায় নিতান্ত সাধারণ। নির্বোধ-জটিলও দেখা যায়।
ফের দেখা যায়, জ্ঞানেও জটিল; জটিল জ্ঞানের সাধক এবং চরিত্রেও জটিল। অতএব কথাটা সহজ করে বললে যা দাঁড়াচ্ছে, তা হল- একটা মানুষ জ্ঞানেও জটিল, চরিত্রেও জটিল।
আমি ঠিক তা-ই। আমি আমার নামটা নিয়েও জটিলতা করেছি। নাম নিয়ে জটিলতা করার ব্যাপারে আমি একটি অখ্যাত বাঙালি লেখকের লেখা ও পত্রিকায় মুদ্রিত গল্পের সাহায্য নিয়েছিলাম। গল্পটা বাংলা গল্প। হলেও ইংরেজি নামে সেটি ছাপা হয়েছিল। গল্পের নাম Kamal Chowdhury.
আমার নামও ঠিক তা-ই। ওই গল্পটার নামই আমার নাম। কিন্তু পাঠক, বলুন তাে, আপনি ঠিক কী নামে আমাকে শনাক্ত করছেন? কমল, নাকি কামাল? ঠিক এখান থেকেই জটিলতার শুরু।
তখন কলেজেও রােল কল হত। অ্যাটেনডান্স খাতা থেকে নাম ধরে ধরে ডাকা হত। স্যর ডাকলেন, ‘কমল চৌধুরী?
আমি সাড়া দিলাম- ‘ইয়েস স্যর!’ আমার সহপাঠীরা জানল, আমি কমল। যে-মেয়েরা আমার সঙ্গে পড়ত, তারাও জানল, আমি কমল বই অন্যকিছু নই।
কিন্তু পাঠকদের কানে কানে বলি আমি কিন্তু কামাল চৌধুরী, বাবার নাম নীরজ চৌধুরী। সাং শালিখার দিয়াড়, মুর্শিদাবাদ।
আমরা গ্রামের বড়লােক। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগের গল্প এটা,
কমল কাহিনি।
আমি প্রথম থেকেই সাহেব। ছেলেবেলা থেকেই। মুসলমান সাহেব। বটে, ব্রিটিশ সাহেবও বটে, আবার ইংরেজ সাহেব হওয়ার দিকে ঝোক যারপরনাই। সেটা হওয়া যায় ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যকে রপ্ত করে। এটাকেই বলা হয় ইংরেজ সাজবার শ্রেষ্ঠ উপায়।
আমার ঠাকুদ্দার নাম ছিল শরৎ চৌধুরী; আমি শরতের পােতা। শরৎ ছিলেন সে কালের পণ্ডিত মানুষ। সংস্কৃত এবং ইংরেজির দিগগজ। সবচেয়ে পুরনাে হাইস্কুলের নামজাদা টিচার। উনিই আমাকে সাহেব বানিয়ে তােলেন পুরােমাত্রায়। নিতান্ত কম বয়স থেকে ইংরেজিতে চমকপ্রদভাবে সড়গড় হই। দু’জনে কাছাকাছি থাকলে ইংরেজি ছাড়া বাতচিত হতই না বললে চলে। অন্যরা হাঁ হয়ে শুনত।
আমি অঞ্চলের এবং স্কুলের বিস্ময়বালকে পরিণত হয়েছিলাম। কলেজেও আমি এক বিস্ময়। কলেজে বাংলা বলতামই না; সহপাঠী-সহপাঠিনীরা জানতই যে, আমি বাংলা বলব না। ওরা বাংলায় বললে বলবে, আমি ভুল করেও বাংলা মুখে আনব না। বাংলার প্রতি এই অবহেলা; এই জিনিসে আমি অপার আনন্দ পেতাম। যে ছাত্র বা ছাত্রী ইংরেজিতে কাচা ছিল, সে আমার ব্রিটিশ ইংরেজি বুঝতে না পারলে, আমি সে কথা অঙ্গভঙ্গি করে এবং মূকাভিনয় করে দিব্যি বুঝিয়ে দিতাম। এই ব্যাপারটা সহপাঠী বন্ধুরা দারুণ উপভোেগ করত।
শিবপূজন ঠাকুর কলেজের ঘণ্টা বাজাতেন। তার সঙ্গে ইংরেজি সহযােগে আমার মূকাভিনয় একটি সাড়াজাগানাে ঘটনা; সে ঘটনায় পূজনদার আমােদ-আহ্লাদের শেষ ছিল না।
তিনি এক বিচিত্র ইংরেজি বলে আমার সঙ্গে সঙ্গত করতেন। রাকা একদিন এই কাণ্ড দেখতে দেখতে একা একা হাসিতে লুটিয়ে পড়ছিল। সেদিন কোনও এক রাষ্ট্রনেতার আকস্মিক প্রয়াণে কলেজ ছুটি হয়ে । গেলে, সবাই যখন চলে গেছে; আমি একা পূজনদার সঙ্গে মাঠের মধ্যে মূকাভিনয়-অলংকৃতি ইংরেজির চর্চা করে চলেছি। কলেজ করিডর পেরিয়ে একাই হাসতে হাসতে এগিয়ে এল রাকা। ওর বুকের উপর দু’হাতে আগলানাে বই। সে কাছে পৌছেও হেসেই চলেছে। রাকা সুন্দরী এবং অভিজাত। ও সেদিনই আমার প্রেমে পড়ে গেল। অর্থাৎ, রাকা দাশগুপ্ত পড়ল প্রেমে কমল চৌধুরীর। সে প্রায় পাগলের দশা হল তার। যখন কলকাতায় এমএ পড়তে এলাম, সে-ও এল। কলকাতায় রাকাদের নিজস্ব বাড়ি ছিল সােনারপুরে। ওঁর বাবার চেম্বারও ছিল বাঘাযতীনে। বড় ডাক্তার ছিলেন ওর বাবা। বহরমপুরেও চেম্বার ছিল। উনি দুই জায়গায় যাতায়াত করে চেম্বার চালাতেন।
আমি যাদবপুরে একটি মেসে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশােনা করেছি। মেসেও আমি কমল চৌধুরী। মেসের অন্যরা বাঙালি হিন্দু ছাত্র। আমিও হিন্দু বেশেই সেখানে জায়গা নিই। সেই মেসে এসে রাকা আমাকে ডেকে নিয়ে যেত। রাস্তায় নেমে হাঁটতে হাঁটতে আমাদের কথা হত। আমরা ট্রেন ধরে সােনারপুরে এসে নামতাম।।
তখনও সােনারপুর গ্রাম গ্রাম দেখতে। গাছপালায় আশ্চর্য ছায়াছন্ন। এক ধরনের প্রসন্ন নির্জনতায় ভরা রাস্তা। ওদের বাড়িটা ছিল প্রান্তিক। বাড়ির পিছনে বাঁশবন এবং একটি ছায়ানিবিড় বড় পুকুর। ওই পুকুর পাড়ের বাশবন ঘেঁষে নানান গাছপালার ঝােপের কাছে ঘুরে বেড়াত। বেজির দল, তাদের কোনও ভয় ছিল না। অনেকগুলাে বক চরত। চা-পাখি ছিল। ছাতারে, বুলবুল, মৌটুসি, এমনকী হরবােলা, হাঁড়িচাচা ছিল এবং ছিল মরিচ গুড়গুড়ি।
সেই সজলঘন নির্জনতায় বুকের সঙ্গে ছড়িয়ে আমাকে নিবিড় আলিঙ্গনে রেখে গাঢ় স্বরে রাকা বলল, বাংলায় বলছি কমল। তুমিও বল।’
-‘কী?
–’আমারই মতাে তুমিও কি ভালবাস?
সেই মুহূর্তে নিজেকে আমার নিতান্ত বােকা আর কেমন যেন অপরাধী মনে হল।
রাকার আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করি এক অদ্ভুত অসােয়াস্তির মধ্যে। একধরনের ত্বরা করে অর্ধস্ফুট স্বরে বলে উঠি- ‘ঠিক আছে।’
এটা যে এ মুহূর্তের জবাব হল না, তা বুঝতে পারি। তবে, এটা যে রাকাকে এড়াবার জন্যে বলা, সে তাে ঠিক একশােবার। কিন্তু একথার প্রতিক্রিয়া রাকার তরফ থেকে হল অন্যরকম।
রাকা আরও নিবিড় করে আমাকে আঁকড়ে ধরে বলে ওঠে, ‘হ্যা, ঠিক আছে বইকি। খুবই ঠিক আছে কমল।’
-‘মানে!
‘বিয়ের ব্যাপারে বাবা বাধা হবে না। কারণ, বাবার মধ্যে একটা আত্মকুণ্ঠা আছে।’
-‘আত্মকুণ্ঠা! এটা বেশ ভারী, মানে দুরূহ শব্দ রাকা! সহজ করে বল!’
-‘আচ্ছা, আমরা বিয়েটা যদি স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্টে করি!’
নিজেকে এবার রাকার আবেষ্টনী থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার আরও একটু জোর চেষ্টা করতে করতে বলি, ‘তােমার কথার একবর্ণও বােঝা যাচ্ছে না রাকা?’
‘আসলে সহজ! আমার বাবা-মা স্পেশাল বিয়েই করেছেন কিনা! ধর্মের ব্যাপারে আমাদের ফ্যামিলিতে কোনও জোরাজুরি নেই কমল। আহ! অমন কেন করছ! এভাবে জড়িয়ে থাকলে তােমার কি লজ্জা করছে এবং আমাকে বেহায়া মনে হচ্ছে!’ বলে ওঠে রাকা।
‘আমরা সােফায় বসে কথা বলতে পারি! ঘরে যাই।’ বলে উঠলাম।
‘এখানে প্রকৃতির মধ্যে ভয় কীসের! আচ্ছা, তােমার কোনও মুসলমান বন্ধু আছে?’ এভাবেই দু’টি বাক্যকে প্রায় খাপছাড়াভাবে ব্যবহার করে কথা বলে উঠল রাকা।
রাকার এরকম কথার জবাবে বললাম, ‘আছে।’
-‘কী নাম?’
-‘শরৎ!’
-‘মুসলিম বন্ধুর কথা বলছি কমল!’
-‘শরৎ কিন্তু মুসলমান।’
-‘ও! তােমার সেরা বন্ধু কে?’
-‘শরৎ!’
-‘রিয়েলি?’
-‘আমি সাদা বাংলাতেই বলছি। শরৎ-ই আমার শ্রেষ্ঠ বন্ধু। আমি ওঁর মুরিদ। মানে ফলােয়ার।’
‘কখনও বলনি তাে!’ বলে গলায় কিছু অবাক সুর আনলে রাকা। ধীরে ধীরে আমার থেকে নিজেকে আলগা করে নিয়ে ওর একটা হাত দিয়ে আমার একটা হাতের মুঠো চেপে ধরে পাশে দাঁড়াল রাকা দাশগুপ্ত। সামনে মরিচ গুড়গুড়ি পাখিটা ছটফট করে চরে বেড়াচ্ছে। একটি খাড়ালােম, ধূলিমাখা নেউল ওর পাশ দিয়ে ব্যস্তভাবে কোথায় ছুটে চলে গেল।
-‘তুমি মুসলিমদের ভালবাস রাকা!
-‘খু-উ-ব!’
-কেন?’
এবার কথা না বলে থমকে রইল রাকা দাশগুপ্ত। গাছপালা, নির্জনতা ও পাখির কিচকিচ-কিচিরমিচির; পুকুরের জলে ছায়া পড়া নিস্তরঙ্গ ছবির দিকে চেয়ে রইল সে। ছায়া গাঢ় হল। আমরা চুপ করে রইলাম।
তারপর আমরা ঘরে এলাম। চা তৈরি করল রাকা। নানারকম সুস্বাদু বিস্কুট সহযােগে চা খেলাম। আমরা কথা বললাম না। তারপর নিঃশব্দে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসে বাড়ির সদর গেটের কাছে এলাম। এসে ঘুরে দাঁড়ালাম এবং গেটের একটা শিক হাতের মুঠোয় ধরে বললাম, গেটের ওপাশে রাকার মুখের উপর। দৃষ্টি ন্যস্ত করে- ‘শরৎকে আমি যারপরনাই ভালবাসি রাকা। তিনি যা চান তা-ই আমাকে করতে হয়। ওঁর কথা ঠেলবার মতে জোর আমার মধ্যে কণামাত্র নেই। আচ্ছা, চলি।’
গেটের শিকে জড়ানাে আমার মুঠো আঙুলে ছুঁয়ে মাথা নিচু করে নরম সুরে রাকা বলল, ‘আমার মা মুনশি ফ্যামিলির মেয়ে। মুসলমান। মাকে বিয়ে করে। বাবার মনে একটা কেমন সংকোচ জমেছে; একটা অর্থহীন কুণ্ঠা। তােমার সঙ্গে আমার বিয়ে হলে সেটা কেটে যাবে। আধেক হিন্দু, আধেক মুসলমান, এতে একটা বলতে না-পারা দ্বন্দ হয় কমল!’
বললাম, ‘ছ’মাস আগে যদি বলতে! তাহলে তােমাকে আমি পুরােপুরি মুসলমান করে দিতাম। তােমায় পূর্ণ হিন্দু করার সাধ্য আমার নেই। আমি ঠাকুদ্দা শরৎ চৌধুরীর আবদারে নিতান্ত গরিব আমার মামাতাে বােন শারিয়া খাতুনকে নিকাহ করেছি রাকা। আমি কমল নই। কামাল।’
এই বলে গ্রিলের সদর গেট ছেড়ে পথের উপর প্রায় লাফিয়ে পড়লাম আমি।

পিছনে আর ফিরে দেখিনি রাকার চোখ-মুখের অবস্থা কী হয়েছিল; কী আঘাত সে পেয়েছিল! আমি যেন চোরের মতাে পালাচ্ছিলাম! আমি চরিত্রে জটিল, চিন্তাভাবনা-মেধায়-দীপ্তিতেও জটিল। আমি পালাচ্ছিলাম।
এবং মনে মনে চাইছিলাম, রাকা যেন এরপরেও আমারই থাকে। আমার উপর থেকে রাকা যেন তার মনটা তুলে নিতে না পারে!
হলও তাই। সে আমার মেসে এসে ফের ডেকে উঠল-‘কমল! কমল আছে? কমল চৌধুরী!’
মেসের বন্ধুরা বলল, ‘কমল! দেবাে কে এসেছে!’
তারপর আবার আমরা সােনারপুরের রাস্তায়।
-‘তুমি ঠিক করােনি। বোনকে বিয়েতে তোমার বাধল না?’
-‘দাদাসাহেব মানে, ঠাকুন্দাকে সে কথা আস্তে করে বলেছি বইক! দাদাসাহেব বলেছেন, বােন তাে কী! আবে এ বিয়েকে রাজযোটক বিয়ে বলা হত। ওই মহাগরিব শারিয়া তােমার পক্ষে হালাল। হালাল আওরত। না কোরো না। ওই বােনটাকে স্ত্রী বানায়ে উদ্ধার করো।’ এই বলে একটা দম নেওয়ার চেষ্টা করি।
ঈষৎ কান্না জড়ানাে গলায় রাকা বলে ওঠে, ‘হালাল আওরাত, কথাটা বেশ। কামাল ভাই! কিন্তু তুমি এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করে বসবে, তা ভাবতেই পারিনি।’
-‘বিধবা মাসি দাদাসাহেবকে কেঁদেকেটে বশ করে ফেলে। ভাবলে, আমি ফসকে যেতে পারি। কিন্তু বিশ্বাস করাে, আমি শারিয়াকে পর্যন্ত বোঝাতে চেষ্টা করেছি, বলেছি, এ বিয়ে সুখের হবে না শারি। তুই না করে দে। তুই তে। বােন! সারি (দন্ত্য-স দিয়ে উচ্চারণ করতেই কমলের আরাম বােধ হয়) বললে, বােন তাে কী! আমার কোনও অসুবিধা নেই। তােমাকে সেই কবে থেকেই তো, খেলনাবাটি খেলার সময় থেকেই তাে ভেবে আহ্লাদ করছি ভাই!’
-‘থাক! আর শুনব না কমল। আমি কী ভেবেছিলাম আর কী হয়ে গেল! তােমার ছদ্মনামটাকেই এখনও আমি ভালবাসি। তুমি যে কামাল, সে কথা বাবাকে এখনও বলিনি। বললে, বাবা কী বলবে কে জানে! তবে, মা চুপ করে থাকবে। সারির গল্পটা কম কিসে মিস্টার চৌধুরী! তবু বলি, সারিকে তুমি তালাক দাও!’
-এক্সকিউজ মি!’
-‘তােমার বােন, সারি! সাবিকে তালাক দাও, কমল! আমাকে বিয়ে করে।’
-‘এ জিনিস হয় না রাকা!’
-‘হয়।’
-‘কী করে হয়?’
-‘তালাক, তালাক, তালাক। বায়েন তালাক বললেই!’
আমি আর কোনও কথাই বলি না। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ি। তারপর ঘুরে দাঁড়াই। উল্টো দিকে একা হাঁটতে থাকি। রাকা যেন মাটিতে পুঁতে গিয়ে মৃতি হয়ে যায়। আমি আর পিছনে ফিরে তাকাই না। সােজা স্টেশনে হেঁটে চলে আসি।
ট্রেন ধরে যাদবপুরে মেসে ফিরে আসি। তারপর এই কলকাতা শহরে থেকেও আমাদের মধ্যে আর দেখাসাক্ষাৎ হয়নি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় দুটি ছিল পৃথক এরিয়ায়। ফলে, দেখা না করলে দেখা না হওয়ার উপায় কিছু ছিল। এভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশােনার পাট একপ্রকার চুকল। আমাদের জীবন থেকে ঝরে গেল আরও কিছু সময়।
আবার আমরা কলকাতায় ফিরলাম। আমাদের দু’জনেরই দু’টি বিখ্যাত কলেজে চাকরি হল। কিন্তু সে কথা দু’জনই জানতাম না। একদিন কলেজ ছুটির দিনে কী যে হল, যাদবপুরের বাসা থেকে বেরিয়ে ট্রেন ধরলাম। এসে পৌছলাম সােনারপুরের সেই গাছপালা-পাখি-প্রকৃতির ছায়ায় পুকুর পাড়ে। এই ঘটনা ঘটল। বছর সাত বাদে।
দাড়িয়ে রয়েছি। পিছন থেকে একটি ছায়া এগিয়ে এল। আমাকে ধরলে জড়িয়ে। আমার পিঠে উষ্ণ চোখের জল ঝরে পড়ল- ‘এবার তােমার মামাতে বােনটাকে তালাক দাও কমল চৌধুরী। যদি বল, তাহলে আমি সারির কাছে গিয়ে তােমাকে চাইব। বলব, সাত বছর তুমি কমলকে পেয়েছ, এবার আমাকে দাও।’
রাকা তারপর আমার বুকের কাছে এসে আমার চোখে চোখ তুলে বুকের জামা খামচে ধরে চেয়ে রইল। তার পলক পড়ছিল না একেবারে।
আমি বললাম, ‘বিনাদোষে আমি সারিকে তালাক দিয়েছি, শুধু এই ভরসায় যে, তুমি এখনও বিয়ে করেনি। তালাক তে খােদার তরফ থেকে পুরুষকে দেওয়া মস্ত একটা অধিকার, রাকা দাশগুপ্ত।’
এই বলে আমি কেঁদে ফেললাম ওই নিসর্গের নির্জনতায়। তারপর রাকা আর আমার সুখের জীবন শুরু হল। গ্রাম ছেড়ে কোথায় চলে গেল সারি, কেউ জানল না। সারি সংসারে একেবারে একা হয়ে গ্রাম ছেড়ে গেছে। তালাকের আগেই ওর বিধবা মায়ের মৃত্যু হয়েছিল। ওর আসলে কোনও আশ্রয়ই ছিল না কোথাও। তবে, সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, সারি আমার কাছে কোনও খােরপােশ দাবি করেনি।
কাজের মেয়ে খুদি ওরফে খােদেজা বেওয়া (বিধবা) আমাকে একদিন বললে, ‘আমি একদিন শুধালাম ছােট চৌধুরী, খােরপােশের মামলা করলে তাে পারতে সারি বহিন! তাই শুনে সারি বললে কী, না বুবু, ভাইয়ের বিরুদ্ধে মামলা, সে আমি পারব না! হিয়াকে শরৎ চৌধুরী নিয়েছে, ইংরেজি শিখিয়ে মানুষ করবে, শরৎ মারা গেলে প্রফেসর কমল চৌধুরী তাে রইল খুদি বুবু। আমার দুঃখ কীসের!’
-‘আর কী বললে সারি?’
খুদি বললে, ‘শুধালাম, তাহলে ফির কি একটা নিকাহ করবে সারি। শুনে কাহিল করে হেসে বললে, জীবনে আমি একজন ফরিস্তার সঙ্গে সহবাস করেছি খুদি বুবু; অন্য পুরুষে কী মন ভরবে! একই জীবনে কী বেহেস্ত-দোজখ করা যায়, বল!
বললাম, ‘থাক খােদেজা! আর না!
–’জি! আমিও সেই কথা বলি ছােট চৌধুরী! থাক!’
বছর তিনের মেয়ে হিয়া চৌধুরী রাকার কাছেই মানুষ হতে থাকে। রাকা হয়ে ওঠে তার মা। ধীরে ধীরে। আমিও ধীরে ধীরে সারিকে ভুলে যাওয়ার জন্য যে যে যুক্তি হলে হয়, সেই সবই সাজিয়ে তুলি। জীবন চলতে চলতে একটা ছন্দও গড়ে নেয়।
কিন্তু তার পরেও গল্প অন্য এক অভাবিত মােড় নেয়। বােঝাই যায় না, গল্পটা কীভাবে এগােচ্ছে!
আমার লেখাপড়ার ঘরটা মূল বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে। যদিও একটা লম্বা, অতিলম্বা বারান্দা, সরু বারান্দার সঙ্গে যুক্ত। বেশিরভাগই রাতেই পড়াশােনা করতে করতে এই স্টাডিতেই ঘুমিয়ে পড়ি। এখানে শােয়ার জন্য একখানা ইংলিশ খাট এবং সজ্জিত বিছানা রয়েছে।
বেশিরভাগ রাতেই ঢের রাত পর্যন্ত পড়াশােনা করে ইংলিশ খাটের বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ি। অনেকসময় রাতের খাবার স্টাডিতেই দেওয়া হয়। রাকার বিছানায় যাই নিতান্ত কম। ও-ও আসে কম। সম্পর্কের মধ্যে ঈষৎ শৈত্যভাব এসে গিয়েছে; অবশ্য তা নিয়ে আমরা খুব কিছু টেনশন করি না। তবে ভবিষ্যতে সমস্যা হবে কিনা কে জানে! আমি মাঝে মাঝে সারিকে স্বপ্নে দেখি দু’-এক ঝলক। সে আঁচলে করে সাদা সাদা নানাধরনের ফুল নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসে। ওর স্মিত হাসি। চোখ দিয়ে ইশারা করে মুঠোয় করে। ফুলগুলাে তুলে নেওয়ার জন্য। তারপর কোথায় মিলিয়ে যায়।
বাস্তবে কতকটা সেই ধরনেরই ঘটনা ঘটে যায়। স্টাডির বাইরের দিকের দরজার কাছে কেউ এক গােছা করে সাদা ফুল রেখে যাচ্ছিল খুব ভােরে ভােরে; ভােররাত্রের দিকে। কিন্তু কখন রেখে যাচ্ছিল, ঠাহর করা যাচ্ছিল না। ঘটনা বড়ই বিচিত্র।
কিন্তু কে এই কাজ করছে, ধরতে হবে। আমি রাকাকে এই ঘটনার কথা বলিনি। ভােরে ওঠার অভ্যাস। আমার আছে। রাকার উঠতে দেরি হয়। কিন্তু কতটা ভােরে সে আসছে, বােঝাই তাে যাচ্ছে না।
সে রাতে ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে রেখে চারটে নাগাদ খাটে উঠে বসলাম। বাইরের দিকের জানলায় চোখ রেখে অন্ধকারে বসে রইলাম। সাড়ে চারটে নাগাদ তাকে রাস্তার উপর দেখা গেল।
আমি দরজাটা ভেজিয়ে রাখলেও লক করিনি বা খিল আঁটিনি। ও এসে বাইরের ছােট ছােট সিঁড়ি ভেঙে দরজার কাছে যে পৌছে গেল, তা জানলা দিয়ে পুরাে দেখা না গেলেও টের পেতে অসুবিধা হল না। ও যখন ফুল রেখে সিঁড়ি দিয়ে নেমে লন পেরিয়ে রাস্তায় পড়ল, আমি দ্রুত দরজা খুলে ওর পিছনে ছুটে গেলাম।
কেউ যে তাকে ফলাে করছে, তা সে টের পেয়ে যায়; সামনের ওই চলমান বােরকা পরা নারীমূর্তিটি। কে ও? ও থমকে দাঁড়াল, চকিতে পিছনে ফিরে দেখল। তারপর দ্রুতই ঘুরে গিয়ে দ্রুততর বেগে হেঁটে, যেন-বা উড়ে যেতে চাইল। স্টেশনের দিকে। আমি আজই শেষ পর্যন্ত দেখতে চাই। কে এই নারী? কোথা থেকে আসে? কেন এভাবে ফুলের অর্ঘ্য দিতে আসে?
ভালই করেছি, দরজা খুলে বার হওয়ার মুহূর্তে পাঞ্জাবির পকেটে টাকাপয়সার পার্সটা দ্রুত ঢুকিয়ে নিয়েছি। পাসেই ট্রেনের মান্থলি রয়েছে। ট্রেন এল। ও উঠল। আমিও ওর পিছু পিছু। ট্রেন এখানে মিনিটখানেক দাঁড়ায়। ট্রেন ছাড়ল। ট্রেনের কামরায় ও ছাড়া মাত্র একজন যাত্রী। আর সে হল আমি। ট্রেন শিয়ালদা পৌঁছলে চাদ্দিক কিছুটা বেশ ফর্সা হয়ে এল। যদিও সূর্য এখনও ওঠেনি।
ট্রেন থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করল সে। আমি যথারীতি ওর পিছু নিলাম। মিনিট দশ-বারাে হেঁটে এসে বউবাজারের কোনও একটা গলি এবং তা থেকে আরও কোনও গলির মধ্যে দিয়ে অন্য একটা গলিতে এসে বেশ একটা সরু গলিতে ঢুকে একটা দরজা ঠেলে সরুতর গলিজাতীয় জায়গা পার হয়ে একটা কাঠের সিঁড়ি দিয়ে সম্ভবত দোতলার একটা ঘরের দরজার সামনে থামল এবং দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে বােরকা-মূর্তি বলল, ‘এস!’
আমি মন্ত্রচালিতের মতাে ঢুকে পড়লাম। সে খাটে বােরকা পরা অবস্থায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। নীচের থেকে বােরকা কোমর অব্দি তুলে ফেলে নিম্নাঙ্গে পুরােপুরি উলঙ্গ হয়ে সে আমাকে আহ্বান করল ‘এস, আমার ভেতরে এস! লজ্জা কোরাে না। বেপাড়ায় থাকি। দেহের ব্যবসা করে খাই। কিন্তু আমার কোনও বাজে রােগ নাই। এস, ভয় কী! দেখাে, এখনও বা স্তনে বাদামি জডুলটা আছে, চৌধুরী! কী হল?’
আমি শিউরে উঠে দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেললাম। বললাম, ‘নিজেকে ঢাক সারি। প্লিজ!!
সারি বলল, আমাকে এক হিন্দুবাবু রেখেছিল। তার ঔরসে দুইখানা বাচ্চা আছে ছােট ছােট। সে-বাবুটা আমাকে ছেড়ে অন্য এক নতুন বাংলাদেশি রেখেছে। সংসার চালাতে বড় কষ্ট ভাই! আমাকে রাখবে? এখানে। রেখেই তােমার রাখনি করবে? সাহেব! কিপ মি প্লিজ!’
ছিটকে চলে এলাম পথে। সপ্তাহখানেক বাদে আমি ওই পাড়ায় যাই। হ্যা সারি তােমাকে রাখব’ বলতে। কিন্তু সে ওখানে ছিল না। কোথায় সে, কেউ বলতে পারল না। সারি, শারিয়া- এই নামে কেউ ওই পাড়ায় থাকত না। সারির ব্যবসায় অন্য নাম হয়েছিল, সন্ধ্যা। সন্ধ্যাকে আমি খুঁজছি। হা, ঈশ্বর, ওর ওই কথাটা ‘কিপ মি প্লিজ’ এখনও কানে বাজছে। থামছে না।

নতুন ভিডিও গল্প!

Please follow and like us:


Source link


Comments are closed here.